Image description

বিপ্লব আলী: পাকিস্তান বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল দেশ। ভঙ্গুর অর্থনীতি, জীবন মানের নিম্নগতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও মুদ্রাস্ফীতি ইত্যাদি কারণে দেশটি দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক অরাজকতা, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, বৈদেশিক হস্তক্ষেপ, ক্ষমতার পালাবদল, উপদলীয় রাজনীতি, অভ্যন্তরীণ জঙ্গি হামলার ও সেনাবাহিনী একচেটিয়া প্রভাবের ফলে দেশটি চরম সংকটে পড়েছে।

তবে পাকিস্তানে রাজনৈতিক অরাজকতা নতুন কিছু ঘটনা নয়। দেশটি জন্মলগ্ন থেকেই রাজনৈতিক অরাজকতার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। কখনো রাজনীতিতে স্থিতিশীল পরিস্থিতি আসেনি এ যেন দুর্লব বস্তু যা কখনোই পাকিস্তানকে স্পর্শ করতে পারেনি। দ্বিজাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। যদিও দ্বিজাতিতত্ত¡ ছিল একটা বিশেষ শ্রেণি মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার হলেও সাধারণ মানুষের জীবনের উন্নয়ন হয়নি। তাই দ্বিজাতিতত্তে¡ সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার হয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ।

পাকিস্তানের পঁচাত্তর বছরের ইতিহাস বিশেষ করলে দেখা যায় যে দেশটি বেসামরিক সরকার কখনো তার ক্ষমতার পূর্ণ মেয়াদে পূরণ করতে পারেনি। বারবার সামরিক শাসকগোষ্ঠী পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে নিয়েছে। পাকিস্তানের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে ৩৩ বছর শুধু সেনাবাহিনীর হাতে ছিল পাকিস্তান। সেজন্য নিরাপত্তার প্রশ্নটিকে ব্যবহার করেছে সেনাবাহিনী বরাবর। যেহেতু রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের অল্প সময়ের মধ্যেই ভারতের সাথে ভূ-স্বর্গ কাশ্মীর ইস্যুতে সীমান্তে একটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল পাকিস্তান, তার ফলে নিরাপত্তার ইস্যুটি প্রতিষ্ঠিত করা সহজ হয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য। আর বাকি সময় বেসামরিক সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকলেও পাঁচ বছর মেয়াদ পূরণ করতে পারেনি, কখনো পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটো ক্ষমতাচ্যুত কখনো নিজ দেশের জনগণের হাতে নিহত আবার কখনো দুর্নীতির দায়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হারিয়েছেন বেসামরিক সরকার। এমন রাজনৈতিক অরাজকতার কারণে দেশটি অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে পারেনি। যদিও প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে চিরবৈরিতা থাকায় সামরিক সেক্টর অত্যধিক শক্তিশালী হলেও অর্থনীতি ও পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের জীবন মান ঠিক ততটাই ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রভাব প্রতিনিয়ত পড়েছে অর্থনীতির ওপর। অর্থনীতির দিকে তাকালে যে চিত্র ফুটে ওঠে তা খুবই ভয়ংকর। দেশটির অর্থনীতি দেউলিয়াত্বের পথে। সন্ত্রাস প্রকট আকার নিয়েছে। সারাদেশের সব সেক্টরের অস্থিতিশীলতা কোনোমতে চেক দেয়ার মতো নেই। রাজনীতি বেশ আগে থেকেই সেনাবাহিনীনির্ভর। ক্ষমতা সেনাবাহিনী নির্ভর না হলে বিপদ।

পাকিস্তানের যে চলমান রাজনৈতিক অরাজকতা দেখা দিয়েছে তার সূচনা হয়েছিল গত বছরের ১০ এপ্রিল। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরাম খান পালার্মেন্টে অনাস্থা ভোটে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার মধ্য দিয়ে যা এখন পাকিস্তানের পরিস্থিতি থমথমে বিরাজ করছে। গত ৯ মে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার করলে তার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল পিটিআই (পাকিস্তান তেহরিক ই-ইনসাফ) সমর্থকরা পাকিস্তানের বেশ কিছু শহরে তথা লাহোর, সিন্ধু, করাচি ও রাজধানী ইসলামাবাদে বিক্ষোভ মিছিল করে এবং সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্পে অগ্নিসংযোগ করে। মূলত ইমরান খানের ক্ষমতাচ্যুতির পিছনে সেনাবাহিনীর বড় ভূমিকা রয়েছে এমন ধারণা থেকে সামরিক শাসকগোষ্ঠী ক্যাম্পে তাণ্ডব চালিয়েছে পিটিআই। দেশজুড়ে এই প্রতিবাদ-বিক্ষোভ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর জন্য এক অভ‚তপূর্ব চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। পাকিস্তানে বহু দশক ধরে সরাসরি সামরিক শাসন চলেছে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পর অন্তত তিনবার সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। যদিও ২০০৮ সালে সরাসরি সেনা-শাসনের অবসান ঘটেছে।

এখন ইমরান খানের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। কেননা দেশটির সেনাবাহিনীর চাপে পিটিআই থেকে অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা তথা আসাদ উমর, শিরিন মাজারি, আমির কায়ানি, ইমরান ইসমাইল, সাইফুল্লাহ নিয়াজি বা আলী জাইদির মতো নেতাদের দল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা পিটিআইয়ের জন্য ‘অপূরণীয় ক্ষতি’ হিসেবে দেখা দিয়েছে এমন কি তারা উপদলীয় রাজনীতি চর্চা করছেন। ২০১৮ সালে নির্বাচনে ইমরান খানকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সমর্থন দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর সাথে ইমরান খানের সম্পর্ক টানাপোড়েনের ফলে ইমরান খান ক্ষমতা হারায়। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করেন। কেননা, পাকিস্তানে রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর পছন্দমতো বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। এছাড়াও পররাষ্ট্রনীতি ও দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সেনাবাহিনীর সিদ্ধান্ত গুরুত্ব পেয়ে থাকে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও বেসামরিক সরকারের মধ্যে এমন সম্পর্কের ফলে সাধারণ জনগণের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। পাকিস্তান বিশ্বমানচিত্রে এমন একটা দেশ যা রাষ্ট্রীয় সকল সিদ্ধান্তে সেনাবাহিনী কলকাঠি নাড়ে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে ইমরান খান বলেন, ‘আমি আজ আপনাদের পূর্ব পাকিস্তানের কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। মার্চ ১৯৭১ সালে আমি পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছিলাম অনূর্ধ্ব ১৯ দলের হয়ে খেলতে। আমার এখনো মনে আছে তাদের কী তীব্র ঘৃৃণা ছিল পাকিস্তানের প্রতি। আজ আমাদের মনে রাখা দরকার, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের সঙ্গে কী অত্যাচার হয়েছে। তাদের যে দল নির্বাচনে জিতেছিল, যার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা ছিল, তার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী অভিযান চালালো।’ তবে ইমরান খান স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছেন যে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জনগণের প্রতি যেমন বৈষম্য করেছিল পাকিস্তানি সেনাশাসক গোষ্ঠী যা ইমরান ও তার পিটিআই সমর্থকের প্রতি করা হচ্ছে। বাংলাদেশে দীর্ঘ ২৪ বছরের শাসনকালে পাকিস্তান আমাদের প্রতিটা রন্ধ্রে বৈষম্যের পেরেক ঢুকিয়ে দিয়েছে। তবে বাঙালি জাতি যে বীরের জাতি, পরাধীনতার শিকল তাদেরকে চিরস্থায়ীভাবে গ্রাস করতে পারবে না তা স্পষ্ট। তাই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ও তার সেনাবাহিনীকে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তাক্ত যুদ্ধে পরাজিত করে পাকিস্তানের শিকল থেকে মুক্তি পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও শাসকগোষ্ঠীকে পরাজিত করে বাংলাদেশ মুক্তি পেলেও তার নিজ দেশের সাধারণ জনগণেণ এখনো মুক্তি মেলেনি। এখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার নিজ দেশের জনগণের প্রতি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। আর এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে পাকিস্তান হয়তো আবার বিভক্তির প্রশ্ন থেকেই যেতে পারে।

বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর মদদপুষ্ট সরকার শাহবাজ শরিফ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেননি। কেননা, তিনি রাজনীতিতে আসেন পরিবারতন্ত্রের মধ্য দিয়ে। তার বড় ভাই তথা সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ দুর্নীতির দায়ে ক্ষমতা হারিয়ে নির্বাসনে রয়েছেন। তিনি পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট সমাধানে পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছেন। এমন অবস্থায় পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে ধাবিত হবে তা ইসলামাবাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতির সমীকরণ বলে দিবে। আর এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে দরিদ্র, সন্ত্রাসবাদ, উগ্র ধর্মীয় রাজনীতি ও সামরিক হস্তক্ষেপের মতো বিষয় বৃদ্ধি পেতেই থাকবে। -লেখক : কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক

মানবকণ্ঠ/এআই