

শিল্পী নাজনীনঃ গিয়াসউদ্দীন আবুল ফাতেহ ওমর ইবনে ইব্রাহীম আল খৈয়াম নিশাপুরী, সংক্ষেপে ওমর খৈয়াম। ওমর খৈয়াম সম্পর্কে সেই কৈশোরে তৈরি হওয়া আগ্রহটা পরবর্তীতে কমেনি, বরং সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আরো। আজ এই বিখ্যাত কবির ৯৭৫তম জন্মদিন। আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে ১০৪৮ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের ১৮ তারিখে পারস্যদেশ তথা ইরানের নিশাপুর নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন ওমর খৈয়াম। তাঁর বাবা ছিলেন তাঁবু নির্মাতা ও মৃৎশিল্পী। নিতান্তই সাধারণ আর দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা ওমর খৈয়াম পরবর্তীতে নিজ মেধা ও প্রজ্ঞায় হয়ে ওঠেন বিশ্ববিখ্যাত।
ওমর খৈয়াম জন্মগ্রহণ করেন সেলজুক যুগে। তখন ইরানের ক্ষমতায় ছিলেন মালিক শাহ সেলজুক। জন্ম ইরানে হলেও শৈশবের কিছু সময় বর্তমান আফগানিস্তানের বালক শহরে কেটেছিল খৈয়ামের। শৈশবে খৈয়াম বালক শহরে তখনকার বিখ্যাত পণ্ডিত শেখ মুহাম্মদ মানসুরীর তত্ত্বাবধানে শিক্ষাগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তরুণ খৈয়াম জ্ঞানার্জনের জন্য চলে যান সমরখন্দে এবং সেখানেই শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি টানেন। পরবর্তীতে বুখারায় গিয়ে নিজেকে তিনি মধ্যযুগের একজন প্রধান গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।
বীজগণিতের গুরুত্বপূর্ণ 'Treatise on Demonstration of Problems of Algebra' গ্রন্থটি রচনা করে খৈয়াম এখানে ত্রিঘাত সমীকরণ সমাধানের একটি পদ্ধতি বর্ণনা করেন। এই পদ্ধতিতে একটি পরাবৃত্তকে বৃত্তের ছেদক বানিয়ে ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধান করা হয়। ইসলামি বর্ষপঞ্জি সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন খৈয়াম। যখন যে কাজটি করেছেন, তখন সেই কাজের প্রতি নিজেকে তিনি উজাড় করে দিয়েছেন পুরোপুরি। ভালোবাসা আর নিষ্ঠায় সেই কাজটির সঙ্গে নিজেকে করে নিয়েছেন একাত্ম। ফলে সাফল্যের সঙ্গে খৈয়ামের হয়েছিল নিবিড় গাঁটছড়া। তিনি ছিলেন একই সাথে কবি, দার্শনিক, শিক্ষক, গণিতবিদ এবং জোতির্বিদ। কিন্তু এতসব বিষয়ে এত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার পরেও, শেষ পর্যন্ত কবি পরিচয়ের আড়ালে চাপা পড়ে গিয়েছে তাঁর অন্য সব পরিচয়। জীবিতাবস্থায় ওমর খৈয়ামের পরিচিতি ছিল একজন গণিতবিদ হিসেবে।
ইসলামী সভ্যতার সোনালি যুগে, প্রায় হাজার বছর আগে বীজগণিতের যেসব উপপাদ্য এবং জ্যোতির্বিদ্যার তত্ত্ব ওমর খৈয়াম আবিষ্কার করেছেন, সেগুলো এখনও গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদদের গবেষণা কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। পরাবৃত্ত ও বৃত্তের ছেদকের সাহায্যে ত্রিঘাত সমীকরণ সমাধানের পাশাপাশি তিনি দ্বি-পদী রাশিমালারও বিস্তার করেন। ইউক্লিডীয় সমান্তরাল স্বীকার্যের সমালোচনা তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান, যা পরবর্তী সময়ে অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির সূচনা করে। কিন্তু বিশ্ববাসী এখন তাঁকে স্মরণ করে তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ 'রুবাইয়্যাত-ই-ওমর খৈয়াম' এর জন্য।
পশ্চিমা বিশ্বে, বিশেষত মার্কিন মুলুকে কবি হিসেবে রুমির পরেই রয়েছে ওমর খৈয়ামের জনপ্রিয়তা। এর পেছনে আছে দুজন ইংরেজ গবেষক ও অনুবাদকের অসামান্য অবদান। ইরানিয়ানদের বাইরে টমাস হাইড-ই প্রথম ব্যক্তি, যিনি প্রথম খৈয়ামকে নিয়ে গবেষণা করেন। তবে, আঠারোশ শতাব্দীর শেষার্ধের শুরুর দিকে খৈয়াম বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এডওয়ার্ড ফিৎটজেরাল্ডের মাধ্যমে। ফিৎটজেরাল্ড খৈয়ামের চার পঙক্তিবিশিষ্ট ছোট কবিতা বা রুবাই অনুবাদ করে তা 'রুবাইয়্যাত-ই ওমর খৈয়াম' নামে প্রকাশ করেন। ১৮৫৯ সালের আগেও যে ওমর খৈয়ামের পরিচিতি ছিল একজন গণিতবিদ, দার্শনিক, শিক্ষক ও জ্যোতির্বিদ হিসেবে, এডওয়ার্ড ফিৎটজেরাল্ড কর্তৃক চার পঙক্তির রুবাই কাব্যগ্রন্থটির অনুবাদের পর সেই ওমর খৈয়ামই বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পান কবি হিসেবে। ফিৎটজেরাল্ডের মাধ্যমেই খৈয়ামের কাব্যপ্রতিভা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে এবং তাঁর অন্যসব খ্যাতি আড়ালে চলে যায়। গণিতবিদ, দার্শনিক, শিক্ষক ও জ্যোতির্বিদ ওমর খৈয়াম পৃথিবীর কাছে হয়ে ওঠেন প্রেম ও বিরহের কবি। বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ মানুষই তাঁকে জানে কবি হিসেবে।
আজীবন বিজ্ঞানের সাধনায় মগ্ন থাকা খৈয়াম তাঁর কবিতার অসাধারণ ভাব, ভাষা আর গভীর দার্শনিক প্রজ্ঞার কারণে বর্তমান বিশ্বে কবি হিসেবেই অধিক সমাদৃত। তাঁর কবিতায় মুগ্ধ হয়ে বাংলা ভাষার বহু বিখ্যাত জন সরাসরি ফার্সি কিংবা ইংরেজি ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন তাঁর কবিতা। তাদের মধ্যে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কান্তিচন্দ্র ঘোষ, নরেন্দ্র দেব, সিকান্দার আবু জাফর, সৈয়দ মুজতবা আলী ও কাজী নজরুল ইসলামের নাম উল্লেখযোগ্য। বাংলা ভাষাভাষী কাব্যানুরাগীদের হৃদয়ে এঁদের হাত ধরেই ধীরে ধীরে নিজের আসনটি পোক্ত করে নিয়েছেন খৈয়াম।
'রুটি-মদ ফুরিয়ে যাবে
প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে
কিন্তু বই থাকবে অনন্ত যৌবনা
যদি তেমন বই হয়।'
এমন একজন বাঙালির দেখাও কি মিলবে, যিনি শিক্ষিত, কিন্তু সৈয়দ মুজতবা আলীর অনুবাদে এই রুবাইটি পড়েননি? উত্তর 'না' হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। বাঙালিমানসে ওমর খৈয়াম তাই এক কিংবদন্তির নাম। বাঙালির চিন্তা ও চেতনায় যার প্রভাব অনস্বীকার্য।
১১৩১ খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর ৮৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। আজ এই কিংবদন্তি কবির জন্মদিন। জন্মদিনে তাঁর প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
মানবকণ্ঠ/এফআই