

বিপ্লব, সংগ্রাম, রোমান্টিকতা ও জীবনকে ভিন্নভাবে যাপনের কাহিনী কখনো সমরেশ ছেড়ে যাননি। তার ‘গর্ভধারিণী’ উপন্যাস মূলত বৈপ্লবিক। সমাজতন্ত্র, সমাজ পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে হিমালয়ের কোলে, সান্দাকফু পেরিয়ে এক বরফঢাকা গ্রামে নিয়ে গিয়েছিলেন উপন্যাসের তরুণ চরিত্রদের। সেই জলপাইগুড়ির শৈশব-কৈশোরের চা-বাগানের জীবন, শ্রমিক, রাজনৈতিক নেতা থেকে ছোট ছোট চরিত্র ঘুরেফিরে এসেছে শুধু তার প্রধান উপন্যাসগুলোতেই নয়, ছোটগল্পেও। তিস্তার প্রবাহের মতো সেসব আখ্যান একটি প্রজš§কে ভাসিয়েছে আবেগ, ভালোবাসা আর আক্ষেপে। সেই প্রজন্মের একজন আমি। সমরেশ মজুমদারের উপন্যাসের কথা বলতে গেলে মানুষ বাম রাজনীতির কথা বলেন। অনিমেষের গোঁড়ামি আর মাধবীলতার দৃঢ়তার কথা বলেন। জয়িতাদের বিপ্লবের কথা বলেন। তবে সব ছাপিয়ে আমার কাছে স্পষ্ট হয় টুকরো কিছু ছবি। কলকাতা- জলপাইগুড়ি, আঙরাভাসা, ডুয়ার্স এসব ছবি তো ভাসে। আঙরাভাসায় জল, জলের নিচে লাল চিংড়ির দল। চাপ চাপ কুয়াশা, বাদশাহী মেজাজে তারা ভেসে যায় খুঁটিমারীর জঙ্গলের দিকে। গাছভর্তি তীব্র লাল কৃষ্ণচ‚ড়া, সে গাছের ডালে ঝোলানো চা-বাগানের প্রথম রেডিও স্পিকার।
আদর্শবাদী দীপা- অনিমেষ-মাধবীলতাদের অবশ্য একবয়সে বড় মনে ধরেছিল। এখন তাদের সঙ্গে দশ দিগন্তের ফারাক। ইদানিং বরং হাতের মুঠোয় কুঁচো চিংড়ি ধরে রাখা অনির মুখটাই বেশি মনে পড়ে।
অনিমেষ-দীপা-মাধবীলতারা নিতান্তই কাল্পনিক চরিত্র। অথচ মাঝে মধ্যে মনে হয়, কৈশোরের খানিকটা বোধ হয় এদের সঙ্গেও কাটিয়েছি। শুধু উপন্যাস পড়েই তো ক্ষান্ত হইনি। একদিন ভেবেছিলাম, জলপাইগুড়িতে যাব। এ ভাবার বহুদিন চলে গেল, জলপাইগুড়িতে যাই, ডুয়ার্সে যাই। শিলিগুড়ি শহর পার হতেই দুই পাশে ঘন বন; মহানন্দা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। কয়েক কিলোমিটার পরপর সাইনবোর্ডে সাবধানবাণী: হাতি পারাপারের করিডর। বুঝলাম, মাঝেমধ্যেই এখানে হাতির দেখা মেলে, যদিও আমরা দেখতে পাইনি। তবে সুউচ্চ গাছের সারি আর মাঝে চওড়া মসৃণ রাস্তা পরিবেশটাকেই অন্যরকম সুন্দর করে তুলেছে।
প্রচুর বৃষ্টিপাত ও ভূমির গঠনের জন্য এই অঞ্চল জীববৈচিত্র্যে ভরপুর, কয়েকটি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য, অগণিত চা-বাগান ও জাতীয় উদ্যান এর অন্তর্ভুক্ত। বাঘ, হাতি, মহাবিপন্ন এক শিঙের গন্ডারসহ বিভিন্ন প্রজাতির সরীসৃপ ও পাখি এই বনাঞ্চলকে সমৃদ্ধ করেছে। অনিমেষকে খুঁজেছি তীব্রভাবে। পাইনি। তবে স্মৃতির অনেকটাজুড়ে অনিমেষ ঠিকই রয়ে গেছে। সেই রয়ে যাওয়া এমন তীব্র যে আমার অবচেতন মন বোধ হয় বিশ্বাসই করে আঙরাভাসা আদতে তার নিজের শৈশবে হারিয়ে ফেলা নদী।
সমরেশের জন্ম চা বাগানে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত ডুয়ার্স এলাকায় কেটেছে তার ছেলেবেলা, মদেসিয়া শ্রমিকদের বাচ্চাদের সঙ্গে ফুটবল খেলে বড় হয়েছেন তিনি। তিস্তায় তখনও বাঁধ পড়েনি। তিস্তার একদম গা ঘেঁষে বাড়ি ছিল। পাড়ার কাছেই রাজবংশী পাড়া, বাহে সম্প্রদায় বলা হতো এদের। তিস্তার চর সমরেশ মজুমদার নিজের হাতের তালুর মতোই চিনতেন। ঠাকুরদার কাছে থেকে পড়ায় তার মানসগঠনে ঠাকুরদার প্রভাব ছিল। বয়স বছর তিনেক হতেই ভর্তি করা হলো ভবানী মাস্টারের পাঠশালায়। সেখানে সমরেশের হয়ে পরীক্ষায় লিখে দিলেন বয়সে বড় এক দিদি। ধরা পড়ল শিশু সমরেশ।
ভবানী মাস্টার উপদেশ দিলেন, ‘তোমার তো অনেক দূর যাওয়ার কথা। আর কাউকে অ্যালাও করবা না।’ সমরেশ মাস্টারমশাইয়ের এই নির্দেশটিই তার সৃষ্টির ক্ষেত্রে জীবনভর অক্ষরে-অক্ষরে পালন করেছেন। আর তা করেছেন সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিকে দেখার দৃষ্টি বেয়ে। প্রথম কবে সমরেশ মজুমদারের বই পড়েছিলাম, মনে নাই। প্রথম তার কোন বই পড়েছিলাম তাও মনে করে বলতে পারব না। এখন বুঝতে পারি সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বা শংকর আমাদের অপরিণত বয়সকে রাঙিয়ে দিয়েছে। আমার মা তাদেরকে পড়তে প্ররোচিত করেছিল। এখন মনে করতে গেলে যা একটা আবছা ধারণা তৈরি হয় তা হলো সাতকাহনের মাধ্যমে আমাদের বাসায় সমরেশ মজুমদারের আগমন ঘটে। মেজ মামা ছিলেন বামপন্থি। আর আমার শহরটায় যাদের সঙ্গে আমার চলাফেরা, অথবা যারা আমাদের বাসায় আসতেন, তারাও বামপন্থিমনস্ক ছিলেন। তবে বামধারার খপ্পরে পড়ে সমরেশ মজুমদার পড়া শুরু এটা আসলে ঢালাওভাবে বলা ঠিক নয়। আমার কাছে খুব একটা যৌক্তিক মনে হয় না।
সবার ক্ষেত্রে এ আলাপ সত্য নয়। তাহলে পরে প্রশ্ন থেকেই যায়, যারা সমরেশকে পড়েছেন, তারা সবাই বামপন্থি ছিলেন? ততদিনে রাশিয়ান সাহিত্যের একজন একনিষ্ঠ পাঠক। ফিওদর দস্তয়েভস্কি, ম্যাক্সিম গোর্কি, আন্তন চেখভ, তলস্তয়, নিকোলাই অস্ত্রভস্কি- এদের বই আমার হাতে এসে পড়ে, সেটা মেজ মামার কারণে। তারপর ধীরে ধীরে খেলাঘর, ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে সেই স্কুল বয়সেই যুক্ত থাকার কারণে এসব বই পেতে আমার কোনো সমস্যা হতো না। পড়তেও মজা লাগত। তাদের উপন্যাসেও বাম রাজনীতি ছিল মূল উপজীব্য। বিশেষত সমরেশ মজুমদারের ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’ ট্রিলজি বাম রাজনীতিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। তার ‘গর্ভধারিণী’ উপন্যাস আরও বিপ্লবী, নৈরাজ্যিক ঘটনা নিয়ে লেখা।
আলোচিত ‘সাতকাহন’ উপন্যাস নারীবাদী হলেও তা আসলে বাম ভাব তাড়িত।
নিজের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি আর সময়কে গল্পের মোড়কে কালজয়ী করেছেন তিনি। সুনিপুণ লেখনীতে ব্যর্থ বিপ্লবের আক্ষেপ উসকে দিয়েছেন লাখ-কোটি তরুণের মনে। সামাজিক অসংগতির বিরুদ্ধ চেতনার বারুদ ঠেসে দিয়েছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। তার লেখায় এক প্রজন্মের অপ্রাপ্তির আক্ষেপ আরেক প্রজন্মকে করেছে বিস্ফোরণোন্মুখ।
তার উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষের চরিত্র আর ঘটনাপ্রবাহে নিজেকে খুঁজে পেয়েছে অনেক তরুণ। তাদের করেছে স্বপ্নচারী। সাতকাহনের দীপাবলির মতো তরুণী থেকে নারী হয়ে ওঠার অনুপ্রেরণা
পেয়েছে তরুণীরা। হতে চেয়েছে কিশোর গোয়েন্দা চরিত্র অর্জুনের মতো দুঃসাহসী। ১৯৭৫ সালের দৌড় গল্প দিয়ে শুরু করে প্রায় পাঁচ দশক ধরেই গল্প-উপন্যাস দিয়ে একটা প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন সমরেশ মজুমদার। যেকোনো সংবেদনশীল বাঙালি কিশোরেরই ভেতরে ভেতরে ধিকিধিকি জ্বলছিল। ‘কালপুরুষ’ হয়তো এক স্বপ্নরাজ্যের ইশারা রাখে। সমরেশ সেই স্বপ্ন দেখার কথাটিই যেন মনে করিয়ে দেন।