Image description

বাংলা দিনপঞ্জিতে চৈত্র মাস গ্রীষ্মের বার্তা নিয়ে হাজির হয়। কথায় আছে চৈত্রের কাঠ ফাটা রোদ্দুরে মাঠ-ঘাট, পথ-প্রান্তর ফেটে চৌচির হয়। রোদের প্রখরতায় কাঠ ফেটে যায় বলে একে কাঠ ফাটা রোদ্দুর নামেও আখ্যায়িত করে গ্রাম বাংলার মানুষ। প্রতিবারের ন্যায় এবারেও চৈত্র হাজির হয়েছিল তবে তাপদাহের ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে। চৈত্র পেরিয়ে বৈশাখে এসেও যেন তাপদাহের প্রখরতা বেড়েই চলেছে। মাঝে তাপমাত্রার গতি কিছুটা নিম্নমুখী হলেও, ক্রমান্বয়ে তা আবার বাড়তে শুরু করেছে। ধারণা করা হচ্ছে তাপমাত্রা পুনরায় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যেতে পারে। সূর্য আকাশে উঠতে দেরি আছে কিন্তু প্রকৃতিতে রোদের উষ্ণতা ছড়াতে যেন দেরি নেই। গাছ-পালা, পশু-পাখি, নদী-নালা এবং মানুষ তাপদাহে পুড়ছে।

মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনে বাসার বাইরে যেতে হচ্ছে কিংবা কর্মস্থলে যেতে হচ্ছে। শ্রমজীবী মানুষের জীবিকার সন্ধানে রাস্তায় বের হতে হচ্ছে। কিন্তু সবার মুখেই একরকম বিপর্যয়ের চিত্র। গরমের তীব্রতার কাছে সকল মানুষ যেন অসহায়ত্ব প্রকাশ করছে। তাপদাহের কারণে প্রকৃতিতে পাখিদের আনাগোনা কমেছে, তেমনি করে খেটে খাওয়া মানুষরা যারাই রাস্তায় বের হয়েছে গরমে অতিষ্ঠ হয়ে একরকম হাঁসফাঁস করছে। এদিকে বনাঞ্চল উজাড় করে কিংবা গাছ কেটে বড় বড় বহুতল ভবন নির্মাণ, বড় বড় শপিংমল নির্মাণ এবং সেইসব স্থানে বাড়তি মানুষের সমাগম যেন পরিবেশের বিরূপ আচরণের অন্যতম একটা কারণ।

অন্যদিকে, তাপদাহে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবারই নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। তাপপ্রবাহের তীব্রতার একটি মারাত্মক দিক হলো হিট স্ট্রোক। যদিও হিট স্ট্রোক নামটা অনেকের কাছেই অপরিচিত। আবার যারা জানেন এর অনেকেই প্রতিকার সম্পর্কে অবহিত নয়। চিকিৎসা শাস্ত্রের ভাষায়, মানব দেহে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট। তীব্র গরম আবহাওয়ায় শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট অতিক্রম করলে তাকে হিট স্ট্রোক বলা হয়। শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে রক্ত। কোনো কারণে শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে ত্বকের রক্তনালি প্রসারিত হয় এবং অতিরিক্ত তাপ পরিবেশে ছড়িয়ে দেয়। প্রয়োজনে ঘামের মাধ্যমেও শরীরের তাপ কমে যায়। কিন্তু তীব্র গরম ও বাতাসের আর্দ্রতা পরিবেশে বেড়ে গেলে তখন বেশি সময় অবস্থান বা পরিশ্রম করলে শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ঠিক সম্ভব হয় না। এতে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বিপৎসীমা ছাড়িয়ে যায় এবং ফলশ্রুতিতে হিট স্ট্রোক হয়।
তাপদাহে জনজীবনে আবারও হাঁসফাঁস অবস্থা। এ পরিস্থিতিতে কোথাও অতিরিক্ত জনসমাগম হলে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি রয়েছে। এমনকি তাৎক্ষণিক চিকিৎসা না পেলে রোগীর মৃত্যুও ঘটতে পারে। মূলত হিট স্ট্রোকের প্রধান কারণ পানিশূন্যতা। গরমে অতিরিক্ত ঘামলে শরীর ডিহাইড্রেটেড হয়ে পড়ে। গরমের তীব্রতায় শরীর থেকে প্রচুর তরল উপাদান যেমন সোডিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং পটাসিয়াম বেরিয়ে যায়। যার অভাবে শরীরে গুরুত্বপূর্ণ খনিজের ভারসাম্যহীনতা হয়।

প্রচণ্ড গরমে কেউ অসুস্থ বোধ করলে খেয়াল করতে হবে রোগীর মধ্যে হিট স্ট্রোকের লক্ষণগুলো প্রকাশ পাচ্ছে কিনা। যেমন- মাথা ঝিম ঝিম করা, বমি বমি ভাব বা বমি করা, ক্লান্তিবোধ ও দুর্বলতা, মাথাব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা, হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি, শ্বাসকষ্ট, খিঁচুনি ইত্যাদি। যদি কোনো ব্যক্তির মধ্যে এমন লক্ষণ প্রকাশ পায় তাৎক্ষণিকভাবে তাকে যত দ্রুত সম্ভব ছায়াযুক্ত স্থানে নিতে হবে। বাসায় থাকলে ফ্যান চালু করে তাকে ঠাণ্ডা স্থানে রাখতে হবে। ঠাণ্ডা পানি শরীরের ভাঁজে, বগল বা কুঁচকিতে লাগাতে হবে এবং চোখে পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে দিতে হবে। বেশি বেশি পানি কিংবা স্যালাইন, ফলমূলের সরবত পান করাতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তির প্রেশার কমে যাওয়া, প্রগ্রাব বন্ধ, পালস কমে যাওয়া বা অজ্ঞান হয়ে গেলে যতদ্রুত সম্ভব আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

হিট স্ট্রোক এড়াতে বাড়তি নজরদারি রাখতে হবেঃ

১) প্রয়োজনের তাগিদে খেটে খাওয়া মানুষ যারা প্রচণ্ড রোদে কায়িক পরিশ্রম করেন, তাদের হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। যেমন- কৃষক, শ্রমিক, রিকশাচালক। তাদের নির্দিষ্ট সময় পর পর ছায়াতে বসতে হবে, কাপড় ভিজিয়ে ঘাম মুছে ফেলতে হবে এবং অবশ্যই বিশুদ্ধ পানি পান করা বেশি কার্যকরী হবে।

২) শিশু ও বৃদ্ধদের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কম থাকায় হিট স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে। এ ছাড়া বয়স্ক ব্যক্তিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় প্রায়ই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে নানা ওষুধ গ্রহণ করেন, যা হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

৩) যেহেতু শরীরে পানিস্বল্পতা হলে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায় সেহেতু বিশুদ্ধ পানি কিংবা স্যালাইন, ডাবের পানি, বাসায় তৈরি সরবত পান করা এ সময় উত্তম।

৪) জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাসার বাইরে না বের হওয়াই শ্রেয়। বাসার বাইরে যেতে হলে ছাতা, সানগøাস ও পানির বোতল সাথে রাখতে হবে।
সর্বোপরি তাপদাহে পুড়ছে গোটা দেশ। সুতরাং প্রকৃতির এমন বিরূপ আচরণে সর্তকতা অবলম্বন একমাত্র হাতিয়ার।

লেখক: ফার্মাসিস্ট, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।