শিলাইদহের কুঠিবাড়ি কল্পভ্রমণ


  • অনলাইন ডেস্ক
  • ০৯ মে ২০২৩, ১২:৫৮,  আপডেট: ০৯ মে ২০২৩, ১৩:৫৩

শিল্পী নাজনীন: কুঠিবাড়িটা নিঝুম। দর্শনার্থীর ভিড় ছেড়ে গেছে সেই বিকেলেই। ছায়া ছায়া অন্ধকারে দাঁড়িয়ে একাকী ভিজছে এখন। কাঁদছে কি? কার শোকে? না কি আমারই কল্পবিলাসী মন বৈশাখের এই ছায়াঘন অন্ধকারে বাড়িটাকে অচিন কোনো শোক-সায়রে কল্পনা করে ভাসতে চাইছে বিষণ্ণ এক বোধে? একটু আগের ঝুম বৃষ্টিটা ধরে এসেছে প্রায়। হালকা বাতাস বইছে, দারুণ শীতল। গ্রীষ্মের খরতাপে পুড়তে থাকা প্রকৃতি ভীষণ শান্ত এখন, শ্রান্ত। সারাদিন গ্রীষ্মের রুদ্ররোদ্দুরে অঙ্গার হয়েছে, দারুণ গরমে সেদ্ধ হয়েছে যে, সেটা এই মুহূর্তে তার শ্যাম,শান্তশ্রী দেখে বিশ্বাস করা শক্ত। ঝুম বৃষ্টির সাথে হালকা ঝড়ে বিদ্যুৎ গেছে সেই সন্ধ্যার শুরুতেই। গাঢ় মেঘে ঢাকা আকাশের নিচে বাড়িটাকে প্রাগৈতিহাসিক লাগছে এখন, আধিভৌতিক।

টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে এখনো, বাড়িটাকে ঘিরে রাখা ইটরঙা, খয়েরি প্রাচীর ভিজে কালচে হয়ে গেছে অনেকটাই। সন্ধ্যার অন্ধকারে তাকে আলাদা করে আর চেনাই যায় না প্রায়। অনেক অনেক বছর আগের কথা ভাবি। এই বাড়িটা সেদিনও কি এমনই ছিল? এমনই শান্ত, নিঝুম? শতবছর আগের এই জনপদ, এই আকাশ, এই সন্ধ্যার ছায়া ছায়া অন্ধকার, বৈশাখী ঝড়ো হাওয়া, এমনই ছিল সব? না কি আরো শান্ত, আরো নিঝুম, আরো ঢের বেশি প্রাণ বিবশ করা, মন উতাল করা ছিল এইসব জল-হাওয়া, ঘর-গেরস্তালি? বাড়িটার দিকে তাকিয়ে কেমন গা ছমছম করে এই ঘনায়মান অন্ধকারে, বৈশাখের ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মাখা সোঁদা হাওয়ায় দাঁড়িয়ে। সেদিনের সেইসব পাইক-বরকন্দাজ, প্রজা, পালকির বেহারার দল, জমিদার রবিবাবু, কোথায় আজ তারা? কোথায় হারিয়ে গেছেন তারা সবাই? বাড়িটা ঠিক দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে নিথর, নীরব! সেদিন কোথায় ছিলাম আমি? ভাবনাটা আনমনা করে দেয় ভীষণ। উদাস করে তোলে। সময়ের স্রোতে তবে এমন করেই ভেসে যায় জীবনের সব রূপ, রস, গন্ধ, আর জীবনের সব কথকতা! জীবন তবে এমনই এক ঠুনকো ফানুস, সময়ের শরীরে ক্ষনিক বুদবুদ তোলা সামান্য এক পলকা হাওয়া!

গেট পেরিয়ে ঢুকে পড়ি রবিবাবুর কাচারিবাড়ির চৌহদ্দিতে। মনে হয় আমি নই, অন্য কেউ, অন্য আমি প্রবেশ করি রবিবাবুর এই শতবর্ষ পেরিয়ে যাওয়া প্রাচীন বাড়িটার রহস্যময় ঘেরাটোপে। আমাকে ঘিরে ধরে অন্যলোকের কোনো অপার্থিব বোধ। তাতে ক্রমশ তলিয়ে যেতে থাকি তাতে, ডুবে যেতে থাকি। মুঠোফোনের আলোয় পথ হাঁটি অচেনা এক ঘোরে। বামদিকে পড়ে থাকে সেই কাচারিঘর, যেখানে বসে তিনি প্রজাদের দুঃখ-সুখের খবর নিতেন, জমিদারির নানান বিষয় তদারকি করতেন। পায়ে পায়ে গিয়ে বসি মস্ত দীঘির শানবাঁধানো ঘাটে। অন্ধকারে বসে থাকি চুপচাপ। বৃষ্টি ঝরে টুপটাপ, শিশিরবিন্দু হয়ে ঝরে পড়ে গায়ে। পড়ুক। আহা। সেই কতকাল আগে এমনি কোনো সন্ধ্যায় হয়তো রবিও বসেছিলেন এই সুনসান অন্ধকার ঘাটে, শুনেছিলেন ঝিঁঝিদের ঐকতান, পাতা ঝরার ফিসফাঁস, হাওয়াদের কানাকানি। কী কথা সেদিন বেজে উঠেছিল কবির হৃদয়-তানপুরায়, কোন সুর? কবি কি সেদিন বিরহে ব্যাকুল হয়ে ভেবেছিলেন একবারও, এইসব ছেড়েছুড়ে চলে যাবেন তিনি কোনো একদিন, হারিয়ে যাবেন অনন্ত এক জগতের ছায়াপথে, তারই প্রিয়, অতি প্রিয় এই বকুলতলে এসে চোরের মতো চুপিচুপি তাকে স্মরণ করবে এসে কোনো এক অখ্যাত আগন্তুক? ঐ তো দীঘির জলে ভাসছে কবির অতি প্রিয় বোটটি, যাতে সেই বোলপুর থেকে নদীপথে ভাসতে ভাসতে এসে উঠতেন তিনি এই কুঠিবাড়ির আঙিনায়! হাওয়ারা উতল হয়ে বয় হঠাৎ, কানে কানে কী যেন গভীর গোপন কথা কয়, হৃদয় ব্যাকুল হয়ে ওঠে, কী যেন এক বিরহব্যথায় টনটন করে ওঠে মন। আকাশ কাঁদে, বাড়িটাও। আমার চোখ বেয়ে জল নামে অজান্তে কখন। মনে হয় এখানে ধ্যানমগ্ন আছেন কোনো প্রেমিক হৃদয়, বিরহের বিধুর সুরে নৈঃশব্দ্য যাকে ডুবিয়ে রেখেছে আশ্লেষে।

সামান্য আলো, ক্ষীণতম শব্দও ভেঙে দেবে তার ধ্যান, মগ্নতা। বাতাস দীর্ঘশ্বাস ফেলে যায়, করুণ সুরে কী যেন বলতে চায়, আমি গুনগুনিয়ে উঠি, তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে, টুকরো করে কাছি, ডুবতে রাজি আছি, আমি ডুবতে আছি। হঠাৎ শিরশির করে ওঠে শরীর, মন। মনে হয়, আমি একা নই, এখানে অন্য কেউ আছেন, কেউ একজন বসে আছেন আমার পাশে, প্রবল কৌতুকে, অতুল স্নেহে যিনি দেখছেন আমার পাগলামি! কে তিনি? রবিবাবু? জমিদার শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর? কবি?

বিকারগ্রস্ত মন আমার, কত কী যে অলীক ভাবনায় অধীর হয়! বৃষ্টির ঝাপটায় ভেজা শরীরে শীত-শীত লাগে, হাওয়ারা অশান্ত হয়ে কী যেন বলতে চায়, ছড়িয়ে দিতে চায় কী এক গোপন বার্তা। আমি উঠি, এগিয়ে যাই ঠাকুরবাড়ির দরদালানের দিকে। ইতিহাস কথা বলে ওঠে হঠাৎ। মুঠোফোনের আলোয় এ ঘর থেকে ও ঘরে যাই, ছবি দেখি, রবি’র দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত জিনিসগুলো হাত দিয়ে ছুঁই আহা। ছুঁয়ে যেন রবিকেই ছুঁই আমি, কবিকেই স্পর্শ করি সহসা। ঐ তো কবির ব্যবহৃত সেই আট বেহারার পালকি! জমিদার বরীন্দ্রনাথ বসে আছেন তাতে, আটবেহারা তাকে নিয়ে ছুটছে আর সুর তুলছে, হুহুমনা হুহুমনা পালকি চলার ছন্দে রবি দুলছেন মৃদু, মনে মনে ভাবছেন সোনার তরী, বলাকা বা মানসীর বিখ্যাত কোনো পঙ্ক্তি!

রবির ব্যবহৃত খাট পড়ে আছে জীর্ণ শরীরে, টেবিলটা জুড়ে আছে ঘরের এককোন, খাটে আধশোয়া রবীন্দ্রনাথ কোনো এক বইয়ের পাতা উল্টোচ্ছেন গভীর মনোযোগে, তার গৌরবর্ণ কপালে গ্রীষ্মের ভীষণ উত্তাপে জমে উঠেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম, চিকচিক করছে মুক্তোদানার মতো। দেখতে পাই, টেবিলে ঝুঁকে গভীর ধ্যানে কবি করে চলেছেন সঞ্চয়িতার ইংরেজি অনুবাদ, প্রসন্ন হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে তার শ্মশ্রৃমণ্ডিত গম্ভীর মুখ। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আমি সারাবাড়ি ঘুরি। অন্ধকার চোখ সয়ে নিলে নিভিয়ে দিই মুঠোফোনের আলো। সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসি দোতলায়। সব ঘর ঘুরে ঘুরে অবশেষে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই, হাওয়ারা দারুণ ফুর্তিতে বয়ে যায়, টানা বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনেক দূরের দৃশ্য চোখে ভাসে, অন্ধকারে ঝাপসা সব, অস্পষ্ট। আমি তিনতলার সিঁড়ির দিকে এগোই। সিঁড়ির সামনে লোহার শেকল, রড দিয়ে আগলে রাখা। কাঠের সিঁড়ি, দর্শনার্থীর চাপে ভেঙে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে এমন সাবধানতা।

তিনতলায় ওঠা নিষেধ। সাবধানে শেকল পেরোতেই শব্দ ওঠে ক্যাঁচক্যাঁচ। রাতের নিস্তব্ধতাকে খুন করতে চায় গলা টিপে। সন্তর্পণে সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায় উঠি, ঘুরে দেখি, তারপর সোজা ছাদে। দূরে পদ্মা হাতছানি দিয়ে ডাকে। এই পদ্মার বুকেই বোট নিয়ে ভেসে বেড়াতেন রবি, কাটাতেন নিমগ্ন সময়।


poisha bazar