মধ্যবিত্তের ঘাড়ে বোঝার ওপর শাকের আঁটি


  • অনলাইন ডেস্ক
  • ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২০:৫১

মো. রায়হান আলী: বৈশ্বিক নানান প্রকার প্রভাব আর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষজনের দিন দিন সংসার চালাতে অনেকটা হিমশিম খাচ্ছে। নিত্যপণ্যের দাম ক্রয় ক্ষমতার নাগালের বাইরে যাচ্ছে। নিম্ন আয়ের মানুষজনের সংসার চালাতে প্রায় নাভিশ্বাস উঠছে। এসব অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার পিছনে অনেক কারণ দাঁড় করিয়েছেন বিশ্লেষকরা। কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো-বৈশ্বিক করোনার তাণ্ডবে স্বাভাবিক কাজ-কর্ম ব্যাহত, করোনা পরিস্থিতিতে অসংখ্য কর্মজীবী মানুষের হয়েছে কর্মখালি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতি, বিরূপ আবহাওয়ার কারণে কৃষিক্ষেত্রে ফলন কম, দেশের তৈরি পোশাক খাতে বেদেশি বায়ারদের অর্ডারের স্বল্পতাসহ বিভিন্ন কারণ।

বর্তমানে গ্রাম-শহরে কি পরিমাণ ভিক্ষুকের সংখ্যা বেড়ে গেছে তা বলা বাহুল্য। রাজধানীর রাস্তাঘাটে শুধু ভিক্ষুক আর ভিক্ষুক। রাজধানীসহ সারাদেশের রেলস্টেশন’ বাস টার্মিনাল, এয়ারপোর্ট, হাসপাতাল, স্কুল কলেজের সামনে, মাজার, বাসা বাড়ি, রাস্তা ঘাটে এমনকি পাবলিক প্লেজ সহ সর্বত্রই ভিক্ষুকদের ভিক্ষা করার দৃশ্য খুবই দুঃখজনক লাগে। কতো রকমের ভিক্ষুক যে ঢাকা শহরসহ সারাদেশে আছে তার সঠিক পরিসংখ্যান কারো জানা নেই। এমনটা আগেও ছিল তবে সংখ্যাটা মনে হয় অনেক গুণ বেড়েই গেছে।

দেশে নিম্ন আয়ের মানুষজন যে কত বিপদে তা সহজেই অনুমেয়। অনেক বিশ্লেষক বলছে জনগণের মধ্যে একটা নীরব দুর্ভিক্ষ চলমান। ঢাকাকে ভিক্ষুকমুক্ত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে সরকার। প্রথম পর্যায়ে ঢাকার সাতটি এলাকায় এই অভিযান পরিচালানা করা হয়। এরপর পুরো রাজধানীকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তা শুধুই কাগজে-কলমে। বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, ক‚টনৈতিক এলাকায় ভিক্ষাবৃত্তি এবং সামগ্রিকভাবে রাজধানীকে শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তিমুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সরকারি পর্যায়ে যেভাবে সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছে এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অনেকের।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, ২০১০ সালে দেশে দারিদ্র নিরসনে সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন ও ভিক্ষাবৃত্তির মতো অমর্যাদাকর পেশা থেকে নিবৃত্ত করার লক্ষ্যে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর আবাসন, ভরণ- পোষণ এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য সরকারের রাজস্ব খাতের অর্থায়নে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান কর্মসূচি নেয়া হয়। ঢাকা মহানগরের ১০টি জোনে ১০টি এনজিও’র মাধ্যমে ২০১১ সনে ১০ হাজার ভিক্ষুকের ওপর জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। জরিপকৃত ভিক্ষুকদের তথ্য উপাত্ত নিয়ে একটি ডাটাবেইজ তৈরি করা হয়। জরিপে প্রাপ্ত ১০ হাজার ভিক্ষুক হতে ২হাজার ভিক্ষুককে নিজ নিজ জেলায় পুনর্বাসনের জন্য নির্বাচিত করা হয়। দেশব্যাপী প্রসারের পূর্বে পদ্ধতিগত কার্যকারিতা নির্ভুল করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ময়মনসিংহ ও জামালপুর জেলায় ৬৬ জন ভিক্ষুককে রিকশা, ভ্যান ও ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনার জন্য পুঁজি প্রদানের মাধ্যমে পুনর্বাসনের জন্য পাইলট কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। (সূত্র : ১ এপ্রিল, ২০১৮ ইনকিলাব)।

২০২৩ সালে বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দার পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছিল বিশ্বব্যাংক। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছিল, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক না হলে দুর্ভিক্ষও দেখা দিতে পারে। এছাড়াও অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে ২০২৩ সালের সম্ভাব্য খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা সংক্রান্তে নানান ধরনের সতর্ক বার্তা দিয়ে রেখেছে। বিশ্বের ৮২টি দেশের অন্তত ৩৪ কোটি ৫০ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ভুগছে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের খাদ্য নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান ডেভিড বিসলি। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের সাধারণ মানুষ নানান সমস্যায় ভুগছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এর প্রভাব পড়ছে।

সারা বিশ্ব তেল-গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটে ভুগছে। বিশ্ব বাজার নিত্যপন্ন দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী,মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। সর্বত্রই যেন একটা মন্দা ভাব ও সংকটের সময় বিশ্বের সাথে আমরাও অতিবাহিত করছি। পণ্যদ্রব্যের দাম যে হারে বেড়েছে সে হারে শ্রমের মূল্য বাড়েনি। যে হারে বাসা ভাড়াসহ সার্বিক ব্যয়ভার আমাদের কাঁধের ওপর চেপে বসেছে, সে হারে আমাদের আয়ের পরিমাণ বাড়েনি। তাই পূর্বের স্বাভাবিক জীবনে আমাদের একটা হতাশা নেমে এসেছে। সবাই আয়-ব্যয়ের সমান্তরাল ঠিক করতে নানানভাবে জীবন-জীবিকার ব্যয়ভার কমানোর চেষ্টা করছি। মানুষ মৌলিক চাহিদা মেটার পর অবশিষ্ট অর্থ থাকলে একটু স্বস্তির চিন্তা করে। মৌলিক চাহিদার সবচেয়ে অন্যতম হলো মানুষের পেটে ভাত দরকার। আমাদের দেশ কৃষিনির্ভর দেশ। আমরা কৃষির ওপর নির্ভর করে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সব সময় চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।

খাদ্য ঘাটতি পরিস্থিতি প্রসঙ্গে, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সবাইকে অনুরোধ করব কারো কোনো এলাকায় ১ ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। কারণ সারা বিশ্বে এখন যে অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি হয়েছে- আমি যখন জাতিসংঘে গিয়েছি সেখানে অনেক দেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, সবাই খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত যে ২০২৩ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। আরও ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমি বলব আমাদের দেশের মানুষকে এখন থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে’।

জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডবি্লউএফপি) এরই মধ্যে সতর্ক করে বলেছে যে ২০২৩ সালে বিশ্বের ৪৫টি দেশে তীব্র খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এবং ২০ কোটি মানুষের জন্য জরুরি সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে।
গত বছরের অক্টোবর প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক আউটলুক প্রতিবেদনে আইএমএফ বলেছে, ২০২৩ সালে একটি মারাত্মক মন্দার মুখোমুখি হতে পারে বিশ্ব অর্থনীতি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নেমে যেতে পারে ২ দশমিক ৭ শতাংশে। সোনার বাংলার মানুষের সোনার মতো হাসিমাখা মুখ দেখতে সকলের একযোগে অর্থনীতির চাকা সচলে কাজ করতে হবে। খাদ্যের ঘাটতি পূরণে আমাদের আতঙ্কিত না হয়ে কৃষি খাতকে যুগোপযোগী আধুনিকায়ন করতে হবে। বিশ্বের সাথে আমরাও এ পরিস্থিতি সঠিক পরিকল্পনায় মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যেতে চাই।

বিশ্ব খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব নেতারা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশনেত্রীও সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় শুধু সরকারের ওপর দায় চাপিয়ে আমাদের বসে থাকলে চলবে না। জীবন-যাপনে আমাদের মিতব্যয়ী হতে হবে, অপচয় রোধ করতে হবে। সরকারী উদ্যোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগকে আরো বেগবান করতে হবে। দেশের কৃষি খাতকে কিভাবে আরো চাঙা করা যায় তার সমন্বিত পরিকল্পনা করতে হবে। কৃষকের মুখের হাসি কিভাবে ফোটানো যায় সেটার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। দেশের যত অর্থনৈতিক জোন আছে সেগুলোর গতিশীলতা ত্বরান্বিত করতে হবে। দেশে শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। নিম্ন আয়ের মানুষজনের বহুমাত্রিক সমস্যা নিরসনে সকলকে উদ্যোগী ও সচেতন হতে হবে।

লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট


poisha bazar