মায়ের ভাষা, বাংলা ভাষা


  • অনলাইন ডেস্ক
  • ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৬:০৭

জোবায়দা আক্তার জবা: রাষ্ট্র ভাষা পাওয়ার জন্য আমাদের যে রক্ত স্নান তা আসলেই গৌরবের মুখের ভাষা মায়ের ভাষা বাংলা । জন্মেই মায়ের মুখে শুনে শিখেছি আমি মা ডাকতে সেখানে সেই ভাষাতে চলতে চেয়েছি সর্বোচ্চ স্তরে ওঠার সিঁড়িতে। মূলত বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আনার জন্যই ছিল আমাদের লড়াই রফিক সালাম বরকত আরও অনেকের প্রাণের আবেদন পুরনের লড়াই ছিল অফিস আদালত চাকরি সর্বত্র সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে বাংলা।

ভাবলেই গা শিউরে ওঠে যে আমি জন্মে শিখব এক আর আমাকে পড়ালেখা করতে চাকরি করতে অফিসিয়াল কাজ করতে বলতে হবে আরেক! কি ভয়াবহ! কতটা পরাধীন আর যন্ত্রণাদায়ক এরকম পরগাছা হয়ে বাঁচা! আমরা স্বাধীন জাতি মনে প্রাণে রক্তের মাঝে আছে আবেগের ঢেউ। যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে জীবন বাজী রেখে প্রতিবাদ করাই আমাদের অস্তিত্বে মিশে আছে।

আজ এত বছর পর কিছু কথা মনকে নাড়া দিচ্ছে যা না বললেই নয়। এত যে উত্তেজনা এত যে সংগ্রাম আর এত চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পেলাম রাষ্ট্র ভাষা বাংলা! সেই ভাষার যত্ন নিতে পারছি কতটুকু? মুকুট পরা শক্ত কিন্তু মুকুট পরার পর তা ধরে রাখা আরও কঠিন। আমরা বাংলাকে অভ্যাসে নিয়েছি যতটুকু লালন করি কি ততটুকু? প্রচার প্রসার সমৃদ্ধতা বাড়িয়ে তোলার প্রয়াসে কোনো প্রক্রিয়া চোখে পড়ে না। শুধু এই ফেব্রুয়ারি কেন্দ্র করে শহীদ দিবস পালন আর বই মেলা উদযাপন কিংবা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের নিত্যনৈমিত্তিক আচার চালিয়ে গেলেই হবে না প্রয়োজন অনেক বড় কিছু। আমরা হয়তো বুঝতেও পারছি না, ভাবছিও না কিন্তু তলে তলে ক্ষয়ে যাচ্ছে আমার বাংলা।

ভাষা আন্দোলনের এত বছর পর এসেও যখন দেখি আমাদের দেশে ইংরেজি ভাষাকে এত প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে তখন আসলেই নিজেকে অপরাধী মনে হয়।

ইংরেজি এখন ট্রেন্ড একটু ধনাঢ্য পরিবারের বাচ্চাদের পড়তে দেয়া হয় ও লেবেল এ লেবেলে। তারা বাংলায় ভালো করে কথা বলতে পারে না এক থেকে কুড়ি পর্যন্ত গুনতে জানে না অ আ ই ঈ চিনে না! ভাবতে অবাক লাগে! আজকাল অভিভাবকদের মধ্যে শুরু হয়ে যায় দ্বিধা দ্ব›দ্ব বাচ্চাদের কোন মাধ্যমে ভর্তি করবেন বাংলা নাকি ইংরেজি নাকি মাদ্রাসা শিক্ষা মাধ্যমে। চরম একটা অস্বস্তির ব্যাপার।
দিশেহারা হয়ে অনেকেই হাতাশায় ভোগেন। আরও আশঙ্কাজনক হলো আজকাল বেশিরভাগ বাংলা মাধ্যমে পড়াতে চাচ্ছেন না নাজুক অবস্থা অনেক স্কুল কলেজের যেখানে ইংরেজি মাধ্যম ও মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বেড়েছে নতুন নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে হারিয়ে যাবে আমার সাধনার ভাষা।

এত কষ্ট করে পাওয়া বর্ণমালা আমারই সন্তান চিনবে না। আজকাল এমন একটা অবস্থা যেন ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে না পারলে সেই বাচ্চাদের বাবা মা কিছু শেখায়নি, তারা বাঙ্গাল! এরপরে চাকরির ক্ষেত্রে অফিসে, বিভিন্ন মিডিয়ায় এমনকি উপস্থাপনায় যারা কাজ করেন তারাও ভালো ইংরেজি না জানলে যেন কম দামি হয়ে যায়। বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উঁচু স্তরের শিক্ষায় ইংরেজি মাধ্যমে পড়তে হবে বাংলায় কোনো বই নেই। অনুবাদের কোনো ব্যাবস্থা নেই, চেষ্টাও নেই। হয়তো কেউ ভাবছে না বিষয়টা নিয়ে কিন্তু সময় ফুরালে ভেবে লাভ হবেও না। এখনই বাংলা প্রায় হারাতে বসেছে। ইংরেজি না বলতে পারলে তাকে আমরা উচ্চ শিক্ষিত মনে করি না অথচ এই ইংরেজরা দুশো বছর করে গেছে শোষন। ঔপনিবেশিক সেই ভাষায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার নেশাটা আমাদের তীব্র। পৃথিবীর অনেক জাতি অনেক দেশ আছে ইংরেজি বাদ দিয়ে তারা অনেক উন্নত।

যারা ইংরেজি ভাষা বর্জন করে নিজেদের ভাষাকে দিচ্ছে সর্বোচ্চ মর্যাদা। তাদের মধ্যে যেখানে ইংরেজি বাদ দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রতিযোগিতা সেখানে আমরা করি ইংরেজি দিয়ে উপরে ওঠার চাটুকারিতা। পার্শ্ববর্তী দেশ থাইল্যান্ড সেখানেও ইংরেজি বলার প্রবণতা নাই বাংলাদেশের পরিস্থিতি এমন যে নিজেকে একটু জাতে ওঠাতে হলে ইংরেজি বলতে হবে।

অনুবাদের রীতি চালু করা হোক, প্রতিটি উচ্চ শিক্ষা পর্যায়ে একমাত্র এবং অদ্বিতীয় মাধ্যম হোক বাংলা। বাংলা ভাষা হবে জাতীয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উপরে ওঠার একমাত্র সিঁড়ি। অফিসে শুদ্ধ বাংলা না বলতে পারলে লজ্জিত হতে হবে। ইংরেজি নয়, বিসিএস এর মতো সর্বোচ্চ পর্যায়ের চাকরির মৌখিক পরীক্ষা হবে সম্পূর্ণ বাংলায় ইংরেজিতে। প্রশ্ন করে রীতিমতো বাংলা ভাষাকে হেয় করা হয়। বন্ধ করা হোক উচ্চ শিক্ষার নামে ইংরেজি চর্চার এই উদ্ভট ভাব ভঙ্গিমা। কোনো চাকরির পরীক্ষায় ইংরেজি মাধ্যমে প্রশ্ন করার নিয়ম এখন থেকেই বন্ধ করা উচিত। নাহলে আসন্ন বিপর্যয় কোনোভাবে এড়ানো সম্ভব হবে না।

আমি ইংরেজি ভাষাকে ছোট করছি না, সে ভাষার মর্যাদা ইংরেজদের কাছে থাকুক। আমাদের অযথা অতি উৎসাহী হয়ে চর্চা বন্ধ করতে বলছি আর বলছি ইংরেজি হোক ঐচ্ছিক ভাষা! মন চাইলে শিখলাম কিন্তু অবশ্যই প্রয়োজনীয় ইস্যু হিসেবে ইংরেজি নয় আরবি নয় সংস্কৃত নয়। প্রয়োজন একটাই- সব অফিস আদালত গণমাধ্যম সর্বত্র বাংলা ভাষা।

ভাষার মৌসুমে বাংলা নিয়ে কয়েক কলম লিখে কখনো ঋণ শোধ হয় না অথবা শুধু একটা মাসে শহীদ স্মরণে পুষ্প অর্পণেও সম্মান জানানো হয় না! এ দায় তোমার আমার সবার। সকলের প্রাণের শব্দ হবে বাংলা, প্রতিটি দিন প্রতিটি সকাল হবে বাংলা ভাষা নিয়ে। তাকে সমৃদ্ধ করার চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রেখে। বাংলা হবে বাংলাদেশের একমাত্র প্রয়োজনীয় উচ্চ মর্যাদায় আসীন হওয়ার, চাকরি পাওয়ার উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার ভাষা। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে কাজ করে যেতে হবে প্রতিটি স্তরে প্রত্যেকজন বাঙালিকে।
আমরি বাংলা ভাষা বেঁচে থাকুক পরবর্তী প্রজন্মের বিশ্বজয়ের অঙ্গীকার হয়ে।

লেখক: সংস্কৃতিকর্মী


poisha bazar