বাংলা ভাষা কি নিজগৃহে স্বাধীন হতে পেরেছে

- অনলাইন ডেস্ক
- ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৫:৩৮
মো. মমিনুর রহমান: প্রতি বছরের ন্যায় এবারো ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী পালন করা হয়। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে এই অর্জন আকাশচুম্বী। কিন্তু ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা যে রাষ্ট্রভাষা পেয়েছি, তাদের জন্য কতটুকু সম্মান ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছি? ২১ তারিখে দুপুরের পরপরই দেশের বিভিন্ন স্থানে লোকজন ছবি তুলতে জুতা বা স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে শহীদ মিনারের মূল বেদিতে উঠেছে। আবার অনেক জায়গায় ওইদিনেই অনুষ্ঠানে হিন্দি গান বাজানো হয়েছে। এগুলো কতটুকু যৌক্তিক? বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান থাকলে এসব কাজ করা সম্ভব নয়।
আমাদের মনে রাখা দরকার ভাষা পরিবর্তনশীল। একটা সময় রাষ্ট্রে সংস্কৃত ভাষা জাতীয় ও গণমানুষের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও অব্যবহার ও অপ্রচলনের ফলে বর্তমানে বিলীন হয়ে গেছে। সংস্কৃত ভাষার প্রতি মানুষের অসচেতন, অসম্মান, অমর্যাদা ও অসমাদর আজকে হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। বাংলা ভাষার প্রতি এমন অবহেলা ও অবজ্ঞা থাকলে, বাংলা ভাষা যে হারিয়ে যাবে না জোর গলায় বলা মুশকিল। প্রতি ২ সপ্তাহে একটি ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। ইউনেস্কোর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে, বিশ্বের ৬ হাজারের অধিক ভাষার মধ্যে অন্তত ৪৩ শতাংশ ভাষা সংকটাপন্ন।
আমরা হয়তো ভুলে যাচ্ছি, বাংলা ভাষা বিশ্বের অন্যান্য ভাষার মতো বিশিষ্টতাহীন নয়। এটি চেতনার উজ্জীবন। যে কণ্টকাকীর্ণ পথ দিয়ে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উত্থান ঘটেছে ইতিহাসে এমন দৃশ্য বিরল। বোধ হয় সেজন্যই, বিশ্বের প্রায় ৭০০ কোটি মানুষের ৬ হাজারের অধিক ভাষার মধ্যে একমাত্র বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। রাজপথে তাজা রক্তের বিনিময়ে আমরা যে রাষ্ট্রভাষা পেয়েছি বাঙালি হিসেবে আমরা আশানুরূপ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি কী! অফিস, আদালত থেকে শুরু করে ভবিষ্যৎ প্রজšে§র আলোর বাতিঘর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাংলা ভাষাকে পরিপূর্ণ সম্মান ও মর্যাদা দিচ্ছে না। যেসব প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষার উৎপত্তি, ঐতিহ্য ও গৌরবময় ইতিহাস চর্চা হওয়ার কথা সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামগুলোই (লিডিং ইউনিভার্সিটি, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ইত্যাদি) ইংরেজি ভাষা দিয়ে নামকরণ করা হয়েছে মানে গোড়ায় গলদ। দ্যুতির বাতিঘরগুলো নিজেরাই যখন বিদেশি ভাষার বেড়াজালে আবদ্ধ, তাহলে শিক্ষার্থীদের বাংলা ভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে কে বোঝাবে! কে শেখাবে আমাদের ভাষা আন্দোলনের একটা সোনালি অতীত ছিল, কে শেখাবে বাংলা ভাষার জন্য আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল, কে শেখাবে শুধু ভাষার জন্য একমাত্র বাঙালি জাতি রক্ত দিতে পারে!
এসব বিষয় নিয়ে অবশ্যই গবেষণা করা প্রয়োজন। ভাবাও প্রয়োজন। হুটহাট করে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস আদালতের নাম কিংবা দাপ্তরিক কাজে বিদেশি ভাষা ব্যবহারে সতর্ক থাকা উচিত। আমরা যে ভুলটা করেছি নেপাল কিন্তু সে বিষয়ে কঠোর আইন জারি করেছে। নিজেদের ভাষার সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার তাগিদে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নেপালি ভাষায় নামকরণ করতে বাধ্যতামূলক করেছে। অথচ আমরা যেভাবে বাংলাকে জাতীয় ভাষা হিসেবে পেয়েছি তারা কিন্তু আমাদের মতো আন্দোলন, সংগ্রাম করেনি। নিজ দেশের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তারা আসক্ত। যদি আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে বাংলা ভাষাকে অমর্যাদা ও অবজ্ঞা করা হয় তাহলে প্রকৃত বাংলা ভাষা আমরা কোথায় গিয়ে শিখবো, এসব প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। যে প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলা ভাষার সৌন্দর্যকে পরিস্ফুটিত ও পরিষ্কাররূপে তুলে ধরার কথা, সেখানেও হালকা করে ইংরেজি ব্যবহার করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও বাংলা ভাষা আজ নিরাপদে ব্যবহৃত হচ্ছে না। এমনকি অফিস, আদালত, সংস্থা বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে আলোচনা সভা কিংবা অনুষ্ঠানে দায়সারাভাবে বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করা হচ্ছে কিন্তু গুরুত্ব দেয়া হয় ইংরেজি দিনপঞ্জিকার। দেশের প্রথম সারির নাগরিক হওয়ার পরও বাংলা তারিখের প্রতি আমরা উদাসীন এবং অধিকাংশ শিক্ষক ও শিক্ষার্থী বাংলা তারিখের অজ্ঞেয় ।
কয়েকদিন আগে টিভিতে বাংলা ভাষার গুরুত্ব শীর্ষক অনুষ্ঠানে উপস্থাপক ও উপস্থাপিকা বাংলা ভাষার গুরুত্বের কথা বলছেন- ভাষার সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে এবং ইংলিশকে ‘এভয়েড’ করতে হবে। এড়িয়ে চলতে হবে এটা না বলে ‘এভয়েড’ করতে হবে। এরকম বাংলা চ্যানেলগুলো থেকে প্রতিনিয়ত ‘হাই’ ‘হ্যালো’ ‘গুড মর্নিং’ ও ‘বাই’ এসব শোনা যায়। তারাও কিন্তু বিদেশি ভাষাকে ছাড় দেয়নি। এভাবে সর্বদাই যত্রতত্র বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে বিভিন্ন কথাবার্তা শোনা যায়। আমাদের মনে রাখা উচিত, বাংলা ভাষার ৫০টি বর্ণ, প্রতিটি বর্ণই রক্ত দিয়ে কেনা। যা সত্যিকারার্থে বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা আমাদের জন্য মোটেই মানানসই নয় বরং অপমানজনক।
শুধু যে বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলছি তা নয়, লেখার সময়ও ব্যবহার করছি। মোবাইলে কিংবা কম্পিউটারে বর্ণ টাইপ করার সময় বিজয় কী-বোর্ডের তুলনায় অভ্রকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি। বিদেশি ভাষা ব্যবহার করছি সড়কপথেও। রাস্তাঘাটের আনাচে কানাচে ব্যানারে বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি। ব্যানারগুলোতে ‘বাসা ভাড়া দেওয়া হবে’ না লিখে To-Let ব্যবহার করছি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু আমাদের মতো বাংলা ভাষাকে কণ্টকাকীর্ণ অবস্থায় পায়নি, তবুও ওই প্রদেশে কোনো ব্যানার তৈরি করার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে আবশ্যিক করে দিয়েছে। আমাদের দেশে যদি এমন কোনো আইন বা নীতিমালা থাকে বাস্তবে কী তেমন প্রয়োগ হচ্ছে! পশ্চিমবঙ্গ যদি বাধ্যতামূলক করতে পারে তাহলে আমরা কেন নয়?
বাংলা ভাষার মান অক্ষুণ রাখার জন্য অবশ্যই বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। সরকারি বেসরকারি চাকরি কিংবা আন্তর্জাতিক মহলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের অ আ কিংবা ক খ না শিখিয়ে অ ই ঈ উ শেখার প্রতি বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছে। বিশেষ করে গ্রাম থেকে শহরে এই হার অনেক বেশি। শহরের অভিভাবকরা বাংলা মাধ্যম থেকে ইংরেজি মাধ্যমকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে এবং এই হার দিন দিন ত্বরান্বিত হচ্ছে বা হবে। ফলশ্রুতিতে বাংলা ভাষার প্রতি শিশুদের গোড়ালি থেকে এক প্রকারের অনীহা তৈরি হচ্ছে এবং বাংলা ভাষা যে মায়ের সমান এসব বুঝে উঠার সুযোগ হচ্ছে না। বাস্তবিক অর্থে গণমানুষের এমন আচরণ যা ভবিষ্যতে বাংলা ভাষার জন্য অশনিসংকেত হতে পারে।
বাংলা ভাষার মর্যাদা আমরাই কমে দিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে হলে ভাইভা বোর্ডে ইংরেজিতে অনর্গল কথা বলতে হবে। নতুবা আপনি মনোনীত হবেন না। বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি চাকরি নির্ভর করছে ইংরেজিতে দক্ষতার উপর। ইংরেজিতে দুর্বল হলে বিসিএস কিংবা ব্যাংকের মতো লোভনীয় চাকরি হচ্ছে না। কয়েক বছর পর হয়তো ইংরেজি না জানলে কপালে ভাতও জুটতে না পারে। আমি বলছি না ইংরেজি জানা দোষের কিন্তু বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করে বিদেশি ভাষার উপর গুরুত্ব দেওয়া মোটেই প্রীতিকর নয়। সব মিলে বোঝা যাচ্ছে বাংলা ভাষা নিজগৃহে স্বাধীনভাবে ব্যবহত হচ্ছে না। আমাদের খেয়াল রাখা উচিত বিশ্বে বাংলা ভাষায় কথা বলা প্রায় ৩০ কোটি মানুষের অর্ধেকেরও বেশির ভাগ আমাদের এ ভূখণ্ডে। সুতরাং এ দেশের শীর্ষ ব্যক্তি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষকে বাংলা ভাষার সম্মান, শ্রীবৃদ্ধি, উৎকর্ষ সাধন, সমৃদ্ধি আনয়নে এ অঞ্চলের সব শ্রেণির মানুষকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। বাংলা ভাষাকে নিজগৃহে স্বাধীনভাবে ব্যবহার করতে কঠোর আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন এবং তা বাস্তবায়নে সকলের সম্মিলিত সহযোগিতা অপরিহার্য।
লেখক: শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শাখা


