চলমান বিশ্বে ভাষার প্রতিপত্তি ও প্রসার

- ফকির ইলিয়াস
- ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৬:১৯
এটা আমরা সবাই জানি ও মানি কথা বলা, লেখা এবং পড়া দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যেখানে ভাষা হলো অভিব্যক্তি এবং যোগাযোগের প্রাথমিক হাতিয়ার। লোকেরা কীভাবে ভাষা ব্যবহার করে, তা অধ্যয়ন করা- কোন শব্দ এবং বাক্যাংশগুলো তারা অজ্ঞানভাবে বেছে নেয় এবং একত্রিত করে তাও শেখায় আমাদের প্রাত্যহিক জীবন।
আমাদের নিজেদেরকে আরো ভালোভাবে বুঝতে এবং কেন আমরা যেভাবে আচরণ করি তা বুঝতে সাহায্য করতে পারে এই ভাষাই। ভাষাবিজ্ঞানের পণ্ডিতরা যে ভাষা ব্যবহার করেন, সাধারণ মানুষের ভাষা তা নাও হতে পারে। বিশ্বের সব দেশেই এমন উদাহরণ আমরা দেখি। ভাষাবিজ্ঞানীরা ভাষাকে একটি সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও মনস্তাত্তি্বক ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করেন।
স্ট্যানফোর্ডের স্কুল অফ হিউম্যানিটিজ অ্যান্ড সায়েন্সেসের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ার এবং মানবিক বিভাগের প্রফেসর ড্যান জুরাফস্কি বলেন, ‘ভাষাগুলি কেন এবং কীভাবে আলাদা হয় তা বোঝার ফলে মানুষ কি পরিসরে রয়েছে তা অনুমিত হয়। ভাষা সম্পর্কে সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা কী তা আবিষ্কার করা, আমাদের মানবতার মূলমর্ম বুঝতে সাহায্য করতে পারে।’
মানুষ বিশ্বব্যাপী প্রায় সাত হাজার ভাষায় কথা বলে। যদিও ভাষাগুলোর মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। প্রতিটি ভাষাই তার গঠন এবং পদ্ধতিতে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে প্রতিফলিত করে। বাংলা ভাষায় কবিতা লিখেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। বাংলা ভাষায় গান লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আজ সেই কবিতা, সেই গান অন্য ভাষায় অনূদিত হচ্ছে। পাশ্চাত্যের কোনো প্রকাশনী তা প্রকাশ করে লুটে নিতে চাইছে মুনাফা। সবই হচ্ছে বাণিজ্যের কারণে। ভাষা যদি মুনাফা লাভের সিঁড়ি হয়ে ওঠে তাহলে তা যে কোনো মহলে আদৃত হবে না কেন ?
বাংলাদেশই বাংলা ভাষার চারণভ‚মি হিসেবে টিকে থাকবে। কথাগুলো বলছেন বাংলা ভাষাভাষি অনেক প্রাজ্ঞজন। অথচ এ বাংলাদেশেই এখন অনেক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। অভিভাবকরা জানেন ও বোঝেন- তাদের সন্তানদের বিশ্বমাত্রার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গড়ে তুলতে হবে। ভাষাবিদ্যায় পারদর্শী হওয়ার কথা ভাবলে আমরা যে চিত্রটি প্রথমেই দেখি, তা হচ্ছে একটি অগ্রসরমান প্রজন্মের ভবিষ্যৎ। তা নির্মাণে প্রয়োজন নিরলস অধ্যবসায়। একটি প্রজন্ম শক্তিশালী হয়ে দাঁড়াতে দুটি বিষয়ের প্রয়োজন পড়ে খুব বেশি। প্রথমটি হচ্ছে সৎভাবে সমাজের অবকাঠামো নির্মাণ। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে সমকালের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কর্মপরিধির ব্যাপ্তি ঘটানো। কাজ করতে হলে একটি যোগ্য কর্মীবাহিনীর প্রয়োজন পড়ে, যারা তাদের মেধা ও মনন দিয়ে কাজ করবে নিরন্তর।
জ্ঞানার্জনে ভাষা একটি ফ্যাক্টর তো বটেই। কারণ মানুষ না জানলে, সেই তথ্য-তত্ত্ব এবং সূত্রগুলোকে নিজের জীবনে, সমাজজীবনে প্রয়োগ করতে পারে না। সে জন্য প্রয়োজন পড়াশোনা। পড়াশোনা করতে হলে শিক্ষার প্রয়োজন। প্রয়োজন সেই ভাষাটিও রপ্ত করা। বাংলাদেশের নিরক্ষর মানুষ প্রয়োজনীয় অক্ষরজ্ঞান পেলে নিজেদের জীবনমান যেমন বদলাতে পারবেন, তেমনি পারবেন সমাজের চিত্রও বদলে দিতে। একজন শিক্ষিত মা-ই পারেন একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিতে। আমরা সে কথাটি সবাই জানি এবং মানি।
ভাষার যত রকম প্রয়োজনীয়তার সংজ্ঞা আমরা তুলি না কেন, প্রধান কথাটি হচ্ছে একটি জাতিকে শিক্ষিত করে তোলার গুরুত্ব। মানুষ সুশিক্ষিত হলেই তার জ্ঞান খুলবে- সে উদার হবে, সৎ কাজগুলো করবে। এটাই নিয়ম। পাশ্চাত্যে আমরা উচ্চশিক্ষিতের যে হার দেখি, ওই জনশক্তিই রাষ্ট্র গঠন, পরিচালনায় একটি বিশেষ ভূমিকা রাখছে- তা অস্বীকার করার উপায় নেই। ভাষা হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতিতে যোগাযোগের পছন্দের পদ্ধতি। যে ভাষাটির আলো আমরা আমাদের আকাক্সক্ষাকে শক্তিশালী করতে এবং আমাদের শক্তিকে নির্দেশিত ও সারিবদ্ধ করতে ব্যবহার করি। ভাষার অপরিসীম শক্তি রয়েছে এবং এর প্রভাব সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে আমরা কীভাবে এটি পরিচালনা করি তার ওপর। অবশ্য মাঝে মাঝে আমরা এটি উপলব্ধি করি বা না করি, আমরা আমাদের ধারণা এবং বিশ্বাসকে কংক্রিট বাস্তবতায় বিকশিত করার জন্য ক্রমাগত ভাষা ব্যবহার করছি। ভাষার প্রভাব এবং শক্তি সম্পর্কে আরো সচেতন হওয়ার মাধ্যমে, আমরা কীভাবে নিজেকে প্রকাশ করি এবং কীভাবে আমরা অন্যদের ব্যাখ্যা করি সে সম্পর্কে আমরা আরো সচেতন, অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ পছন্দ করতে পারি।
হালে এটা প্রমাণ হচ্ছে, শক্তিশালী ভাষাই বিশ্বে পুঁজির আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ করছে। নিউইয়র্ক তথা গোটা উত্তর আমেরিকার একটি বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা নরটন অ্যান্ড কোম্পানির বেশ কয়েকজন কর্ণধারের সঙ্গে ‘ভাষা ও সাহিত্য’ বিষয়ে আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হয়েছে। তারা একবাক্যে বলতে চান, মুনাফার লোভেই তারা মহাকবি ওমর খৈয়াম, জালালুদ্দিন রুমী থেকে নাজিম হিকমত, রবীন্দ্রনাথ কিংবা মাহমুদ দারবিশের রচনাবলিকে ইংরেজিতে অনুবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, নিজস্ব আঙ্গিকে। তারা তা ইংরেজিতে ছাপিয়েছেন। বাজারজাত করেছেন। এতে বিশ্বসাহিত্যে ওসব মহৎ লেখক যেমন আদৃত হচ্ছেন কিংবা হয়েছেন, তেমনি তাদের বই বিক্রি করে আয় হয়েছে লাখ লাখ ডলারও।
আমি সবসময়ই রূপান্তরে বিশ্বাস করি। রূপান্তরই হচ্ছে ফিরে আসা, অনূদিত হওয়া কিংবা বিবর্তিত হওয়া। বিবর্তন না হলে নতুনের উন্মেষ ঘটে না। তুলনামূলক আলোচনা ছাড়া জানা যায় না বিশ্বের ভাষার নান্দনিক বিবর্তন কীভাবে ঘটছে। লক্ষ করেছি, চলতি সময়ে বইমেলায় বেশকিছু দুর্লভ প্রাচীন ভাষা ও সাহিত্য যেমন চর্যাপদ, সিলেটি নগরী, আদিবাসী শ্লোক নিয়ে বেশ কাজ হয়েছে। আজকের লেখকরা বাংলা ভাষায়ই লিখছেন ক্যারিয়ার গড়াবিষয়ক বই। ওপরে কীভাবে উঠবেন। চাকরির সিঁড়ি কীভাবে নির্মাণ করবেন। ভাষা প্রয়োজনেই শেখে মানুষ।
নিউইয়র্কের একজন নতুন প্রজন্মের বাঙালি-মার্কিন আইনজীবীকে জানি যিনি তার পেশাগত কারণেই শিখে নিয়েছেন বাংলা ভাষা, বাংলা অভিধান তালাশ করে। এগুলো আশার বিষয়। আমি মনে করি এসব উৎস সন্ধানই প্রজন্মকে স্বনির্ভরতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি সাধনের পাশাপাশি ভাষা ও সাহিত্য অঙ্গনেও এগিয়ে যাবে স্বপ্নের বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে এখন বইমেলা চলছে। বই প্রকাশিত হতে শুরু করেছে লন্ডন, নিউইয়র্ক থেকেও স্থানীয় বাংলা প্রকাশনীর মাধ্যমে। কারণ বাংলা কম্পোজ এখন খুবই সহজ। বিভিন্ন ভাষার বেশ কিছু অনুবাদগ্রন্থ ইতোমধ্যে বেরিয়েছে। বাংলাদেশের প্রকাশকরা অনুবাদ গ্রন্থের প্রতি যত মনোযোগী হবেন, ততই লাভ বাংলা ভাষার। বাংলা সাহিত্যের। মূল কথা হল, সাহিত্যের রস আস্বাদন করা। তা যদি ইংরেজিতেও হয় ক্ষতি কী?
ভাষার আলো গ্রহণের একটা প্রতিযোগিতা চলছে আজকের বিশ্বে, নিজেকে টিকিয়ে রাখার কারণেই। বাঙালি প্রজš§ তা থেকে পিছিয়ে থাকবে কেন? মনে রাখতে হবে, ‘ভাষার অর্থনীতি’ নামে একটি শক্তি এখন প্রজন্মের দরজায় কড়া নাড়ছে। যত জ্ঞান- তত অর্থ, এমন একটা নীতি চালাতে চাইছে পশ্চিমা বিশ্ব। ফলে প্রাযুক্তিক শক্তির পাশাপাশি ভাষার শক্তিও দিনে দিনে প্রখর হচ্ছে। যে আলো ধারণ করা প্রতিটি অগ্রসরমান মানুষেরই দরকার।
আরেকটি বিষয় বলা দরকার মনে করি। একটি রাষ্ট্রের ভাষা কি বদলে যায়? ভাষা কি আধুনিক হয়? এসব প্রশ্নগুলো আমরা মাঝে মাঝেই দেখি। বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন ট্রেন্ড শুরু হয়েছে ‘কবিতার ভাষা’। বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকী, লিটল ম্যাগাজিনগুলো ‘কবিতার ভাষা সংখ্যা’ প্রকাশ করছে মাঝে মাঝে। একটি ভাষায়, অন্য ভাষার ঘনিষ্ঠ প্রভাব পড়াটা খুবই স্বাভাবিক। বাংলা ভাষায় অনেক ইংরেজি প্রতিশব্দ মিশে আছে, যা এখন আমরা বাংলা বলেই মনে করি।
ভাষার বদলে যাওয়া সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসী সুইডিশ একজন ভাষা বিজ্ঞানী এডলফ মেকিনসের ভাষ্য হচ্ছেÑ যেহেতু অক্ষর, শব্দগুলো বদলায় না, অতএব মৌলিক ভাষা বদলাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। যা বদলায় তা হচ্ছে বাক্য গঠনের ধরন। চিত্রকল্পের ব্যবহার এবং বাক্য প্রকরণের গতিবিন্যাস। যে কবি অনুপ্রাস কিংবা নেপথ্য চিত্রের আধুনিক বিন্যাস ঘটিয়ে কবিতা লিখছেন, তিনিই দাবি করছেন, তিনি নতুন ভাষায় লিখছেন। যদিও শুধুমাত্র তার বলার ধরনটি বদলেছে। বাংলা সাহিত্যে বিদেশি গল্প, কবিতা, উপন্যাসের ছায়া অবলম্বন করে অনেক গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটিকা রচিত হয়েছে। মনে রাখতে হবে, একটি অন্যভাষার লেখা যখন পাঠকের মনে দাগ কাটে, তিনি যদি লেখক হন, তবে তার আগামী লেখায় এর কিছু প্রভাব পড়তে পারে। প্রজš§ থেকে প্রজš§ান্তরে এভাবেই ছড়িয়ে পড়ছে ভাষার বিবর্তনের আলো। অন্যভাষার দ্যুতিময় সারমর্মকে নিজ ভাষার পাঠকের জন্য তুলে আনাকে এমন দোষের কিছু বলে, বৃহৎ সাহিত্য ভাণ্ডার বিবেচনা করে না।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক


