বইমেলা লেখক-পাঠক-প্রকাশকের এক আনন্দযজ্ঞ


  • অনলাইন ডেস্ক
  • ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৬:৪২,  আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৮:৪৭

সাধনা সাহা: প্রতি বছরের মতো এবারও ভাষা শহীদদের চেতনায় ঋদ্ধ ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিন থেকে শুরু হয়েছে আমাদের প্রাণের মেলা- আমাদের প্রিয় অমর একুশে বইমেলা। হাজার হাজার বইয়ে সুসজ্জিত এক একটা প্যাভেলিয়ন, এমন কয়েক শত প্যাভেলিয়নে বিভিন্ন ধারার, বিভিন্ন মাত্রার, বিভিন্ন বিষয়ের বই নিয়ে, অজগ্র লেখকের আবেগ, অনুভূতি, সুখ, দুঃখের বহিঃপ্রকাশ, প্রকাশনা শিল্পের বিস্তার, প্রকাশকদের হাসি-আনন্দের সুখানুভূতি, ব্যবসায়িক সাফল্যগাথা আর লেখক, পাঠক, প্রকাশকের মিলনমেলায় মুখরিত থাকে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সারা বিশ্বের কোটি কোটি বাঙালির প্রাণের মেলা এই বইমেলা। ফেব্রুয়ারি এলেই প্রতিটি বাঙালির নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে ধ্বনিত হয় এই মেলা।

স্বাধীন বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই মেলার ইতিহাস আমাদের স্বাধীনতার মতোই প্রাচীন। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট মেলা, লন্ডন বইমেলা, আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা, নয়াদিল্লি বইমেলা, কায়রো বইমেলা, হংকং বইমেলা, বুক এক্সপো আমেরিকা বইমেলা(বিইএ) আবুধাবি বইমেলার মতোই বাংলাদেশের বইমেলার ব্যাপ্তি। আজকের এই বইমেলা একদিনে শুরু হয়নি। স্বাধীনতার আগে এই বইমেলার চিন্তাটি প্রথমে করেছিলেন প্রয়াত কথা সাহিত্যক জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক সরদার জয়েন উদদীন।

১৯৬৫ সালের দিকে সরদার জয়েন উদদীন সাহেব যখন বাংলা একাডেমিতে চাকরি করতেন তখন তিনি বইয়ের প্রচার ও প্রসারে এই বইমেলা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা তিনি অনুভব করেন। তন্মধ্যে তিনি ইউনেস্কোর শিশু কিশোর গ্রন্থমেলা উন্নয়নের একটি কাজ পেয়ে যান। কাজটি শেষ করার পরবর্তীতে তিনি একটি শিশুগ্রন্থ মেলার আয়োজনের চিন্তাভাবনা করেন। তার ফলশ্রুতিতে তিনি একটি শিশুগ্রন্থমেলার আয়োজন করেছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি) নিচতলায়। স্বাধীনতা- উত্তর এই মেলাটাই ছিল প্রথম বইমেলা। কিন্তু এই মেলা করে সরদার জয়েন উদদীন সাহেব পুরোপুরি তৃপ্ত হতে পারেননি।

১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জে একটি গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। মেলার ভিতরে তিনি একটি গরু বেঁধে রেখে তার গায়ে লিখে রেখেছিলেন, ‘আমি বই পড়ি না’। সরদার জয়েন উদদীন সাহেবের এই উদ্ভাবনা দর্শকদের ভালোভাবেই গ্রন্থমনস্ক করে তুলেছিল বলেই ধারণা করা হয়ে থাকে। স্বাধীনতার পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের ফেব্রুরুয়ারির আট তারিখে চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণের বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার শুরু করেছিলেন। এই বই কয়টি ছিল চিত্তরঞ্জন সাহার স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমানে মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে অবস্থানকারী বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা বই। এই বইগুলোর পিছনে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রেক্ষাপট।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে চলছিল যুদ্ধের দামামা। আমাদের দেশের বিশিষ্ট লেখক, শিল্পী, সাংবাদিকদের দেশপ্রেমের অপরাধে কারাবাসের শাস্তি প্রদান করা হয়। এইসব শিল্পী, সাংবাদিক, লেখকেরা দেশকে বাঁচাতে, নিজেদেরকে বাঁচাতে পালিয়ে শরণার্থী হিসেবে কলকাতায় অবস্থান করেন এবং নিয়মিতভাবে তাদের সাহিত্যচর্চা, সংবাদ পরিবেশনা করেই যেতেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি, যুদ্ধ চলাকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কে লিখতে চিত্ত বাবু উৎসাহ জোগাতেন। নির্বাসিত এই লেখকদের বই প্রকাশ করার দায়িত্ব তিনি নিজেই নিয়েছিলেন। সে সময়ে চিত্তরঞ্জন বাবু অন্যদের সহায়তায় ‘স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ’ নামে কলকাতায় একটি প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পরবর্তীতে মুক্তধারা প্রকাশনীতে পরিণত হয়েছিল। সেই ৩২টা বই চিত্ত বাবু নিজ দায়িত্বে প্রকাশ করেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রাথমিক উপাদান ছিল এই বইগুলো। সেজন্যই এই বইমেলা বইয়ের ইতিহাসের সাথে সাথে দেশের ইতিহাসেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত এভাবেই বইমেলায় বই বিক্রির চর্চা চালিয়ে যান চিত্তবাবু। বই বিক্রির এই সুন্দর চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৭৬ সালে কিছু প্রকাশক এসে একাত্ম হন চিত্ত বাবুর সাথে। মাঝে ১৯৭৩ সালে এই মেলা চলাকালীন বাংলা একাডেমি স্বতন্ত্রভাবে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশেষ হ্রাসকৃত মূল্যে নিজস্ব প্রকাশনার বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি নিজস্বভাবে ১৪ ফেব্রুয়ারি সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐ সম্মেলন উদ্বোধন করেন। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে মেলার সঙ্গে যুক্ত করেন। ফলে বইমেলা অন্য একটি মাত্রায় পৌঁছে যায়।

জনাব আশরাফ সিদ্দিকীর সক্রিয় ভূমিকায়, বাংলা একাডেমির সক্রিয়তায় সেই দিনের সেই বইমেলা আজকের এই গৌরবময় অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতিও এই মেলায় যুক্ত হয়। উল্লেখ আছে যে, এই সমিতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ঐ সময়ে ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত মেলা হতো। তখন এই মেলার নাম ছিল ‘একুশে গ্রন্থমেলা’।

১৯৮১ সালে মেলার মেয়াদ কমিয়ে ১৪ দিন করা হয়। কিন্তু প্রকাশকদের দাবির মুখে ১৯৮২ সালে আবার মেলার মেয়াদ ২১ দিন ধার্য করা হয়।

১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে প্রথম একুশে বইমেলার আয়োজন করেন। তখন এই মেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ যা নিয়মিতভাবে বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল ২০১৩ সাল পর্যন্ত। ২০১৩ সালে মেলা চলাকালীন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইয়ের স্টলগুলোতে দুর্বৃত্তরা আগুন ধরিয়ে দেয়। এই ঘটনার পর থেকে ২০১৪ সাল থেকে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ বাংলা একাডেমির মুখোমুখি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থানান্তর করা হয়।

প্রকাশকদের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মেলার পরিসর বাড়ানো হয় এবং মেলা একমাস ধরে অনুষ্ঠিত হয়। সঙ্গে বাড়ানো হয় কয়েক স্তরের নিরাপত্তা। সেই ২০১৪ সাল থেকে এই ২০২৩ সাল পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একমাসব্যাপী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মাঝে ২০২১ সালে মহামারী করোনার কারণে গ্রন্থমেলা মার্চের ১ তারিখ থেকে ১৪ তারিখ অনুষ্ঠিত হয়। ২০২২ সালে অবশ্য ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪ মার্চ পর্যন্ত মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সেই ৩২টি বইয়ের ক্ষুদ্র মেলা কালের পরিক্রমায় পরিণত হয়েছে বাঙালির আত্মার আত্মীয়তায় প্রাণের বইমেলায়। পরিণত হয়েছে লেখক, পাঠক আর প্রকাশকের মহামিলনের এক আনন্দযজ্ঞের মহাতীর্থে। এই মেলা ক্রমশ মহীরুহ হোক। টিকে থাক কাল-মহাকাল। জ্ঞানের আলো ছড়াতে বই ও বইমেলা দুটোই জরুরি।

লেখক: কবি ও কলামিস্ট।


poisha bazar