বর্ষ উদযাপনের উন্মাদনা বন্ধ হোক

- অনিল মো. মোমিন
- ০৪ জানুয়ারি ২০২৩, ১৫:৪৯, আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৮:৫০
ক্যালেন্ডারের পাতায় আমরা আরেকটি নতুন বর্ষে পদার্পণ করলাম। গত বছরটা আমরা ভালো-মন্দ মিলেই কাটিয়েছি। বস্তুত সব বছরই এভাবে যায়। এটাই সময়ের বৈশিষ্ট্য। সময়ের স্রোত হাসি-কান্না, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, সাফল্য-ব্যর্থতা ইত্যাদি বয়েই মহাকালের দিকে চলতে থাকে। ফলে আজকে আগত নতুন বছরটিও ভালো-মন্দ মিলিয়ে কেটে যাবে। তাই সময়ের এই পরিবর্তনে আমাদের এতো আবেগ-উচ্ছ্বাসের কোনো গুরুত্ব আছে কি না তা সহজেই অনুমেয়। তারপরেও আমরা জাতি হিসেবে কর্মের চেয়ে অদৃষ্টের প্রতি বেশি নির্ভরশীল বলেই পেছনের সব ঝরা ক্লান্তি কিংবা ব্যর্থতা ভুলতে সান্ত¡না দিতে হিসেবে অনাগত সময়ের অদৃষ্টের প্রতি প্রত্যাশা রাখি। তাই আমরা স্বপ্ন দেখি, বিশ্বাস করি যে নতুন বছর হয়তো আমাদের নতুন নতুন আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। মানুষ হিসেবে এমন আশা প্রত্যাশায় দোষের কিছু নেই। কেননা এই আশা নিয়ে আমরা বেঁচে থাকি। কিন্তু সমস্যা হয়ে উঠে তখন যখন সময়ের এই পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে আমাদের মধ্যে নানান ধরনের উদযাপন করা হয়। উদযাপনের মানবাধিকার থাকলেও সেটা দেশ, কাল, স্থান, অবস্থা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে তা সকলেই জানি। এরপরেও আছে-সেটা যেনো অন্যের জন্য অসুবিধা তৈরি না করে। এই যে নববর্ষ আমরা নব উন্মাদনায় উদযাপন করি সেটা কতটা প্রাসঙ্গিক তা বিবেচনার দাবি রাখে।
প্রথমত, খ্রিষ্টীয় নববর্ষ উদযাপন আমাদের সংস্কৃতি না। এটা না যায় মুসলমানদের সাথে, না যায় এদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাথে, বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতির সাথে। কোনোভাবে মানান সই নয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে কিংবা প্রগতিশীলতার সাথে। কেননা ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল- আমরা যে লড়াইটা করেছি সেটা শুধু রাজনৈতিক- অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যেই না। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ধরে রাখার জন্যেও। তখনকার স্বদেশী আন্দোলন থেকে ভাষা আন্দোলনসহ নানা সাংস্কৃতিক সংগ্রাম ছিল নিজেদের পরিচয়কে গৌরবান্বিত করার প্রচেষ্টা। আমাদের পূর্বপুরুষরা সেটা সফলভাবে প্রতিষ্ঠা করে গেলেও আমরা সেটা এখন পালন করছি কী? বর্ষ উদযাপনে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি হলো বাংলা নববর্ষ। কিন্তু আমরা ভিনদেশী সংস্কৃতিতে বুঁদ হয়ে আছি। খ্রিস্টীয় বর্ষকে ধারাবাহিক ক্রমবর্ধমানে বড় বড় আয়োজনে উদযাপন করছি। আমাদের গৌরবের সেই সংস্কৃতি চর্চা বা চেতনা যেন ভুলে বসে আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ প্রজন্ম, ডান-বাম প্রগতিশীল কিংবা ধর্মানুভ‚তিতে বুঁদ সবাই। যা অত্যন্ত লজ্জার ও হতাশার।
যদি ধরেও নিই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে পরাজিত আমরা। তাই মেনে নেয়া ছাড়া উপায়ও নেই তবুও সময় একটি বিবেচ্য বিষয়। সত্যি হলো এই যে, সময়ের বাস্তবতায় আমরা এখন কঠিন সময় পার করছি। বিশেষ করে অর্থনৈতিক দিক থেকে। আমরা যদি ২০২২ সালের দিকে খেয়াল করি আমরা দেখতে পাই কোভিডের আঘাত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানী সংকট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা, নিম্ন-মধ্যবিত্তদের নীরব হাহাকার। আমরা দেখতে পাই টিসিবির পণ্যের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মুখডাকা মধ্যবিত্ত। কিংবা সারাদিন লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও শূন্য হাতে ফেরা মানুষের আহাজারি। মোদ্দাকথা এদেশটি এখন নীরবে অর্থনৈতিক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। দেশ কিংবা বিশ্বজুড়ে যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় এটি আমাদের সামনের দিনগুলোতে আমাদেরকে আরো বেশি আতঙ্কিত করে তোলে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা আসলে একটা অপ্রয়োজনীয় উৎসব আমেজে থাকতে পারি কিনা এটি খুবই ভাবার বিষয়। কেননা এখন সময়টি বিলাসিতা করার মতো নয়।
এসবের পরেও যদি আবার কেউ যদি বিলাসিতা করতে চায় নৈতিকভাবে তারা এটা করার অধিকার রাখে কি না যখন সেটা মানুষের জন্য ক্ষতির কারণ হয়? নিশ্চয়ই রাখে না। উদযাপনের নামে অন্যের ক্ষতি যেন না হয় সে বিষয়টি খেয়াল রাখা অতীব জরুরি। এই যে উদযাপন করতে গিয়ে বিকট শব্দের আতজবাজি, পটকা ফোটানো, ফানুস উড়ানো আর উচ্চ শব্দে মাইক বা সাউন্ডবক্স বাজানো ইত্যাদি মানুষ ও পরিবেশকে অসহনীয় যন্ত্রণা দেয়ার পাশাপাশি হতাহতেরও কারণ হয়ে উঠেছে। আতশবাজির শব্দে অসুস্থ হয়ে পড়ছে মানুষ। যেতে হচ্ছে হাসপাতালেও। গত বছরে হার্টের রোগী এক শিশুর মৃত্যুর হৃদয়বিদারক ঘটনার কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। থার্টি ফার্স্ট নাইটের রাতের সেই আতশবাজির মধ্যে এক বাবার পোস্ট: ‘কী ভীষণ শব্দে আতশবাজি! আমার ছোট্ট বাচ্চাটি এমনিতেই হার্টের রোগী।
আতশবাজির প্রচণ্ড শব্দে শিশু বাচ্চাটি আমার ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে ওঠে। খুব ভয় পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। খুবই আতঙ্কের মধ্যে সময়টা পার করছি।’ পরের দিন অর্থাৎ বছরের প্রথম দিনেই বাচ্ছা শিশুটি হাসপাতালে মারা যায়। এই আতশবাজি আর পটকা ফুটানোয় আরো কতজন অসুস্থ হলো। কেউ শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। কোথাও আগুন ধরলো। মানুষের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়লো। ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, গত বছর থার্টি ফাস্ট নাইটের প্রথম ২০ মিনিটের মধ্যে সারাদেশ থেকে প্রায় ২০০টি অগ্নিকাণ্ডের খবর পাওয়া গিয়েছিল। যারমধ্যে রাজধানীরতেই ১০টি আগুনের ঘটনা ঘটে। এই আগুন নিয়ন্ত্রণে ওই রাতে ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিট কাজ করেছিলো। ফায়ার সার্ভিস বলছে এসব আগুনের কারণ ফানুস ওড়ানো। এ আগুনে সম্পদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
মূলত ফানুস ওড়ানো থেকে ছোটখাটো দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে জানা যায়, ফানুস ওড়াতে গিয়ে কারো চোখে আগুনের হলকা লেগেছে, কারো চোখে মুখে ফানুসের গলিত মোম পড়েছে। কোথাও পথচারীদের মুখ পুড়েছে ফানুসের আগুনে। বিদ্যুৎ লাইনের সাথে ফানুস আটকে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। কোথাও এলাকাজুড়ে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। শোনা যায় বৈদ্যুতিক লাইনে ফানুস আটকে স্বপ্নের মেট্রোরেল চলাচলও বন্ধ হয়েছে। আবার কোথাও পটকা ফোটাতে গিয়ে কারো কারো হাতের আংগুল উড়ে গেছে। এমন উদযাপনে শহর যেমন অসহনীয় তেমনি গ্রামও। সারাদিন মাঠেঘাটে কর্মক্লান্ত মানুষ রাতে একটু শান্তির ঘুম দিবে সেটা হয়ে ওঠে না। উচ্চ শব্দের কারণে অসহনীয় রাত কাটায় সাধারণ মানুষগুলো। আবার গ্রামে নববর্ষ উদযাপনে পিকনিক আয়োজনে চুরির ঘটনাও ঘটে।
গতকাল রাতে শহরবাসী আতশবাজির তীব্রতা উপলব্ধি করেছেন। ফেসবুকে অনেকেই বলছেন ঢাকার আকাশে যেন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দামামা বাজছে। মুহুর্মুহু আলোকচ্ছটা আর বিকট শব্দে যেন আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে নগরী। নববর্ষের এই উদযাপন শুধু মানুষের শারীরিক-মানসিক, আর্থিক ক্ষতি করে তাই নয়। বরং পরিবেশের ভারসাম্যও নষ্ট করে। নষ্ট করে জীবজগতের বাস্তুতন্ত্রেরও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা গেছে উচ্চ শব্দ আর আলোর ঝলকানিতে পাখিরা দিগি¦দিক ছুটছে শূন্যে। একদিকের শব্দে অন্যদিকে ছোটে তো আরেকদিক থেকে শব্দ। যেদিকে ছোটে সেদিকেই শব্দ আর আলোর ঝলকানি।
ভীতসন্ত্রস্ত পাখিরা এভাবে নাস্তানাবুদ হয়ে ছটফট করে উড়ছে। ওদের ছটফটানি বিবেকবানদের আত্মা কাঁপিয়ে দেয়। অনেকে জানিয়েছেন সকালে মৃত পাখি পড়ে থাকতে দেখেছেন। কেউ দেখেছেন আহত পাখি। পাখিদের জন্য নববর্ষ উদযাপন যেনো এক কালরাত হয়ে আসে। শহরে এমনিতে পাখিদের বাসস্থান নেই। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও রমনা পার্কে কিছুটা বাসস্থান থাকলেও মানুষের এমন কর্মকাণ্ড অদূরেই পাখিশূন্য করে দিবে রাজধানী। সরকারি কঠোর বিধিনিষেধ থাকলেও এসব নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। নাগরিক সচেতনতা ছাড়া এ ধরনের গর্হিত কাজ বন্ধ করা দুরূহ ব্যাপার। তাই আমাদের জাগতে হবে। শুভবুদ্ধি উদয়ের মধ্য দিয়ে মানুষ, মানবিকতা, পরিবেশ ও অর্থনীতির স্বার্থে বন্ধ হোক নববর্ষ উদযাপনের নামে এ ধরনের বর্বরতা।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।


