ঠাকুরগাঁওয়ের গণহত্যা

- অনলাইন ডেস্ক
- ১২ ডিসেম্বর ২০২২, ১৬:৩৬
আহসান হাবিব: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যাকাণ্ড চালায়। এটা বিশ্বের নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ড। এখনো আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি মেলেনি। বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যায় ৩০ লাখ মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসর শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহযোগিতায় এ হত্যাকাণ্ড চলে। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত পাঁচ হাজার বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায়। চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে এক হাজারের ওপর। বধ্যভ‚মি থেকে অসংখ্য মাথার খুলি, শরীরের হাড়গোড় ও চুল পাওয়া গেছে।
গোবিন্দনগর মন্দির ও গণকবর: ঠাকুরগাঁও ইপিআর ক্যাম্পে ছিল পাকিস্তানিদের হেডকোয়ার্টার। ক্যাম্পে দিনের বেলা অসংখ্য মানুষকে হত্যা ও নির্যাতন করা হতো। গোবিন্দনগর মন্দিরের গণকবরে ইয়াসিন আলীকে রেখে তার ৫ সন্তানকে একে একে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। পরে মাটি খুঁড়ে কবর দেওয়া হয়। কিছুদিন পর ইয়াসিন আলীও মারা যান। ইসলামনগর ছিল আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। সেখানকার ছাত্রনেতা আহাম্মদ আলী, ইয়াকুব হোসেন, মোজাফফর, দবিরুল ইসলাম, নূরুজ্জামান ও সিরাজ উদ্দিনকে ধরে নিয়ে বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরেরা। পরে তাদের লাশ ফেলে দেওয়া হয় টাঙন নদে।
রানীশংকৈল বধ্যভূমি: রানীশংকৈলের ক্যাম্পে পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজাকার ও শান্তিবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের মা-বাবা ও আত্মীয়স্বজনকে হত্যা করে।
জাটিভাঙা বধ্যভূমি ও গণহত্যা: ঠাকুরগাঁও সদরের বালিয়া ইউনিয়নের কিসমত সুকানপুকুরী মৌজার জাটিভাঙা গ্রামটি এখন বিবাহপল্লী নামে পরিচিত। এখানে ২৩ এপ্রিল প্রায় আড়াই হাজার মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসররা। স্বাধীনতা ঘোষণার পর রাজাকার, আলবদর ও আল-শামসের সহায়তায় হানাদার বাহিনী মুক্তিকামী জনগণের ওপর অমানবিক নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে শুরু করে। এ নির্যাতন থেকে বাঁচতে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়া, শুখানপুকুরী, জগন্নাথপুর, চকহলদি, সিংগিয়া, চন্ডীপুর, বাসুদেবপুর, মিলনপুর, গৌরীপুর, খামার ভোপলা, দিনাজপুরের বীরগঞ্জের পলাশবাড়ী ও পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামের কয়েক হাজার সংখ্যালঘু পরিবার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে থাকে। ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল কৌশলে তাদের জাঠিভাঙ্গা নদীর পাড়ে জড়ো করে হানাদার বাহিনীর দোসররা। রাজাকাররা খবর দিলে হানাদার বাহিনী চারদিক থেকে সব নারী-পুরুষকে ঘিরে ফেলে। এরপর গুলি আর ধারালো অস্ত্র দিয়ে প্রায় আড়াই হাজার পুরুষকে হত্যা করে ফেলে দেওয়া হয় নদীতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এটিই ঠাকুরগাঁও জেলার সবচেয়ে বড় গণহত্যার ঘটনা।
ঠাকুরগাঁও পুলিশ লাইনে গণহত্যা: ঠাকুরগাঁও পুলিশ লাইনে পাশে রয়েছে সাত জোড়া কবর। ১৯৭১ সালে এখানে ছিল একটা কুঁড়ে ঘরের মাদ্রাসা। এই এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হামলা চালায় এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষজনকে ধরে নিয়ে এসে হত্যা করে। এলাকার সমিরুদ্দীন, হাবিবুর রহমান, সাইফুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম, আবদুস সামাদ, শামসুল ইসলামকে এখানে গুলি করে হত্যা করে।
ঠাকুরগাঁও সুগারমিলে গণহত্যা: পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার থেকে অনেক তখন ভারতে চলে গেছেন। থেকে গিয়ে ছিলেন সুগার মিলের গার্ড জহুর হোসেন, সিনিয়র ইলেকট্রিশিয়ান আসগর আলী। পাকিস্তানি বাহিনী খবর পেলে তাদেও দুইজনকে একত্রে গুলি করে হত্যা করে। মিলের প্রবেশের মূল ফটকের বাম পাশে তাদের জোড়া কবর রয়েছে।
বয়েন্ধা চৌধুরীপাড়ার গণহত্যা: ঠাকুরগাঁওর পরীগঞ্জ উপজেলার বয়েন্ধা চৌধুরীপাড়ায় একেই পরিবারে সাতজন মানুষকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হত্যা করে। বিহারিদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ওই এলাকায় রুটিন মাফিক হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করত।
ফাড়াবাড়ি হাটের বধ্যভূমি: ঠাকুরগাঁওয়ের ফাড়াবাড়ি হাটের বধ্যভ‚মি এলাকায় রয়েছে একটি কুয়া। এখানে আশপাশের গ্রামগুলো থেকে অবাঙালি বিহারিদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৮ জন মানুষকে ধরে নিয়ে এসে গুলি করে হত্যা করে। পরে লাশগুলো কুয়ায় ফেলে দেওয়া হয়।
রুহিয়ার রামনাথ হাটের গণকবর: ১৯৭১ সালে ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়া থানার রামনাথ হাটের কানিকশালগাঁ গ্রামের নূরুল ইসলামের পরিবারের ছয়জনকে ধরে নিয়ে এসে হত্যা করে। ছয় শহীদ হলেন রফিকুল ইসলাম (আবুল), আজিম উদ্দিন আহমেদ, আজিম উদ্দিন আহমেদের নাতি মো. বেলাল (বেলু), তার ছোট ভাই মো. জালাল, মো. রেজাউল ও দেলোয়ার।
তেঁতুলতলা ফার্ম গণহত্যা: পীরগঞ্জ উপজেলা থেকে তৎকালীন সাতজন রাজনৈতিক নেতাকে ধরে নিয়ে এসে পীরগঞ্জ-ঠাকুরগাঁও পাকা সড়কের তেঁতুলতলা ফার্মে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে পাকিস্তানের সেনারা। শহীদের মধ্যে পীরগঞ্জের গোলাম মোস্তফার স্মরণে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে।
পীরডাঙ্গী বধ্যভূমি: পীরগঞ্জের পীরডাঙ্গি ১৯৭১ সালে কারবালা প্রান্তরে পরিণত হয়েছিল। পাকিস্তানি হানাদারেরা পীরডাঙ্গীকে বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহার করেছিল। লাচ্ছি নদীর কোল ঘেঁষে একটি জনমানবহীন বিস্তীর্ণ ধু ধু প্রান্তরজুড়ে হাজারো বাঙালির মাথার খুলি, বুকের পাঁজর, হাত-পায়ের হাড় ও রক্তমাখা কাপড় পাওয়া যায়। বিভিন্ন স্থান থেকে বাঙালিদের ধরে এনে জীবন্ত অবস্থায় তাদের শরীরের মাংস কেটে কুকুরকে খাওয়ানো হয়েছে। পেট্রল ঢেলে জীবন্ত জ্বালানো হয়েছে। গলা কেটে, বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে, গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে নিরীহ বাঙালিদের।
বালিয়াডাঙ্গি বধ্যভূমি: বালিয়াডাঙ্গির মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক দবিরুল ইসলাম ও মোহাম্মদ আলীর পিতা আকবর আলীকে বাড়ি থেকে ডেকে এনে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনারা। একই থানার ঝিকরগাছা গ্রামের ২৫ জন নিরীহ লোককে বাড়ি থেকে বালিয়াডাঙ্গি ক্যাম্পে ধরে এনে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
খুনিয়াদীঘি বধ্যভূমি: খুনিয়াদীঘির নাম শোনেননি ঠাকুরগাঁওয়ে এমন মানুষ নেই। রানীশংকৈল থানায় ছিল পাকিস্তান সেনাদের ক্যাম্প। এই ক্যাম্পে রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের সহযোগিতায় ধরে আনা হতো অগণিত বাঙালিকে এবং নির্যাতনের পর হত্যা করে এই খুনিয়াদীঘিতে ফেলে দেওয়া হতো।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, তিন হাজারেরও বেশি বাঙালিকে হত্যা করে খুনিয়াদীঘিতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। খুব কম লাশই তারা মাটি খুঁড়ে গর্তে পুঁতে রাখত। পাকিস্তানি সেনারা অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে টাঙন নদে ফেলে দেয়। পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসরেরা ছাত্রনেতা আহমদ আলী, ইয়াকুব হোসেন মোজাফ্ফর, দবিরুল ইসলাম, নূরুজ্জামান, সিরাজ উদ্দিন প্রমুখকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে টাঙন নদে ফেলে দেয়। সন্তান মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় সদর থানার ফারা বাড়ির শেখ শহর আলী ও তার ভাই শেখ বাহার আলীসহ ১৯ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে ১৫ মে পাকিস্তান বাহিনী তাদের ক্যাম্পে ধরে আনে। পরে গুলি করে হত্যা করার পর মৃতদেহগুলো একটি গর্তে চাপা দিয়ে রাখা হয়। এ ছাড়া হরিপুর বধ্যভূমি, রুহিয়া ডিগ্রি কলেজ বধ্যভূমি রয়েছে।
মানবকণ্ঠ/এআই


