Image description

জিয়াউল হক: আওয়ামী লীগ কি আপনা-আপনি প্রতিষ্ঠা হয়েছে? না। আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কারা করেছে? তার জবাব ইতিহাস দেবে। কিন্তু কেন করা হয়েছে? সে প্রশ্নের সদুত্তর দলটি প্রতিষ্ঠাকাল হতে প্রতিনিয়ত দিয়েই চলছে। একটা বিষয় আমাদের সবসময়ই মনে রাখতে হবে আওয়ামী লীগ কোনো প্রেসক্রিপটেড পার্টি নয়। বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য সাধনেও গঠিত হয় নাই। আওয়ামী লীগের জন্ম কোনো সেনা ছাউনিতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে কিংবা গণতন্ত্রের বুকে স্বৈরতন্ত্রের তীর বিদ্ধ করে ক্ষমতার মসনদ পাকাপোক্ত করতেও দলটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে নাই। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা হয়েছে জাতির ক্রান্তিলগ্নে। অন্ধকারের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত এ জাতিকে আলোর পথে টেনে তুলতে।

বাঙালি জাতির জাতীয়তাবোধ ও জাতিসত্তাকে জাগ্রত করতে আওয়ামী লীগের ভূমিকা অনস্বীকার্য। স্বাধীনতা পাওয়া যে সম্ভব তা বাঙালিকে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে এ দলটি। হাজার বছরের প্রবঞ্চিত এ জাতিকে আত্মপরিচয় ও আত্মমর্যাদায় বলিয়ান হতে শিখিয়েছে আওয়ামী লীগ। পরাধীনতার শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিল এই জাতি। দুইশ’ বছর আগে পড়ানো বিলেতি সেই শৃঙ্খল ছিন্নের আশায় বাঙালি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনেও শরিক হয়েছে। কিন্তু কাক্সিক্ষত সেই মুক্তি অধরাই রয়ে গেছে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের ফলে ব্রিটিশ বিদায়ে শাসকের বদল হলেও শোষণ হতে নিস্তার মেলেনি। বরং আগের চেয়ে আরও অনেক বেশি মাত্রার শোষণ নিয়ে বাঙালির বুকে চেপে বসেছিল শাসক পশ্চিম পাকিস্তান।

বাঙালিকে শুধু তাদের ন্যায্য অধিকার হতে বঞ্চিত করা হয়নি। তাদেরকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সংস্কৃতিক ভাবেও পঙ্গু করে দেয়ার অপচেষ্টা হয়েছে। শাসক পাকিস্তানের কদর্য রূপ সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ভাষার প্রশ্নে। দুইশ’ বছরে ব্রিটিশ শাসকেরা যে চেষ্টা করে নাই পাকিস্তান দু’বছরেই তা করার দুঃসাহস দেখিয়েছিল। বাঙালি জাতিও ভাষার প্রশ্নে ছিল আপোসহীন। তারা রাজপথেই তার ফয়সালা করেছিল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি অকুতোভয় বাঙালি বুকের তাজা খুনে লিখেছিল মাতৃভাষা রক্ষার এক নতুন ইতিহাস। আর এই ইতিহাসের বৃহৎ অংশ জুড়ে রয়েছে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ।

ভাষা আন্দোলন হতে শুরু করে গণতান্ত্রিক সকল আন্দোলন ও  বাঙালির অধিকার আদায়ে আওয়ামী লীগ সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। বাঙালি জাতির সকল অর্জন আওয়ামী লীগের হাত ধরে এসেছে। ইতিহাসই তার রাজসাক্ষী। আওয়ামী লীগ ও  বাংলাদেশের ইতিহাস একই সূত্রে গাঁথা। আর এই ইতিহাসের মহান রচয়িতা বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।  হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক  ও উদীয়মান তরুণ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অগণিত নেতাকর্মী সমর্থকের শ্রমে ঘামে আবেগ ভালোবাসায় তিলে তিলে গড়া সংগঠন আওয়ামী লীগ আজ মহীরুহতে রূপ নিয়েছে। বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের ধারক বাহক এই দলটি এবছর ৭৩ বছর পার করে ৭৪ এ পদার্পণ করল।

আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের ইতিহাস এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে বাংলাদেশের উৎপত্তি সম্পর্কে দু’কথা বলতে বা লিখতে গেলে প্রাসঙ্গিক ভাবে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ সামনে এসে যায়। এই মহান মানুষটিও তার প্রিয় সংগঠন আওয়ামী লীগ ব্যতিরেকে বাংলাদেশের ইতিহাস কল্পনা করা যায় না। পাকিস্তান কায়েমের পর ঢাকার মুসলিম লীগ কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিতেন মুসলিম লীগ সরকারের আস্থাভাজন বলে পরিচিত মাওলানা আকরম খাঁ ও খাজা নাজিমুদ্দিন। যারা দলে প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আর একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিতেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেম।

যারা দলে মোটামুটি প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তো এই দো-টানা আদর্শিক চেতনার দরুন দু গ্রুপের নেতাকর্মীদের মধ্যে তেমন বনিবনা হতো না। এরসাথে যোগ হয়েছিল সরকারের একচোখা মনোভাব। যদিও পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মীয় সাদৃশ্য ছাড়া আর কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় নাই। অভাব অনটন দুর্ভিক্ষ ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। পূর্ব পাকিস্তান থেকে সকল মাল ছামান সহায় সম্পদ শুষে নিয়ে বাংলাকে করেছিল শ্মশান।

পাকিস্তান সরকারের সীমাহীন পক্ষপাতিত্বের ফলে নিজ দলেরই উদারমনা অংশের কাছে বিরাগভাজন হতে থাকে। যা ধীরে ধীরে দলে ও দলের বাহিরেও সমালোচনার জন্ম দেয়। তাদের ভেতরের গরমিল প্রকাশ্যে আসতে থাকে। আর তখনই প্রগতিশীল মনোভাবাপন্ন মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ মুসলিম লীগ অফিস ত্যাগ করে আলাদা অফিস নেন। ১৫০ মোঘলটুলিতে নেওয়া কর্মী শিবিরে দিন দিন কর্মী সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।  আর এই নতুন অফিসে কলকাতা থেকে এসে যোগদান করেন তৎকালীন উদীয়মান তরুণ রাজনৈতিক শেখ মুজিবুর রহমান। সাথে যোগ দেন আসাম ফেরত মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও টাঙ্গাইলের শামসুল হক। এই দুই মহারথীর যোগ দেয়ার বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। টাঙ্গাইলের মুসলিম লীগ সাংসদ প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ পদত্যাগ করেন।

উপনির্বাচনে দুই দফায় মুসলিম লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করে  মওলানা ভাসানী ও শামসুল হক বিজয়ী হলেও সরকারের ছা-পোষা নির্বাচন কমিশন ফলাফল অবৈধ ঘোষণা করেন। এতে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে মুসলিন লীগের নতুন কর্মী শিবিরে আনাগোনা বাড়ান। এই সময় নতুন একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আলাপ আলোচনা চলতে থাকে। নতুন দল গঠনের লক্ষ্যে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে। বিপত্তি দেখা দেয় মিটিং করার জায়গা পাওয়া নিয়ে। এদিকে মুসলিম লীগ সরকারের দমনপীড়ন তো আছেই। বয়সে প্রবীণ হওয়ায় মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি ও ইয়ার মোহাম্মদ খানকে সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করে মিটিংয়ের আয়োজন করে। অবশেষে ২৩ জুন বিকেলে কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে শ’তিনেক লীগ কর্মীর উপস্থিতিতে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয়।

মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে নতুন দলের সভাপতি ও সামছুল হককে সাধারণ সম্পাদক ও কারাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করে ৪০ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি করেন। পুরো পাকিস্তানের জন্য দলের নামকরণ করা হয় ‘নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ যার সভাপতি ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। মিটিংয়ে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক উপস্থিত হয়ে সংহতি প্রকাশ করেন। কিন্তু ওই সময় তিনি সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদ অ্যাডভোকেট জেনারেল (বর্তমানে অ্যাটর্নি জেনারেল) পদে অধিষ্ঠিত হওয়ায় কিছুক্ষণ পরেই স্থান ত্যাগ করেন। অপেক্ষাকৃত তরুণ ও মুসলিম লীগের উদারমনা অংশের তৎপরতায় দলটি গঠিত হয়।

বিধায় দলকেও অসাম্প্রদায়িক করার চিন্তাভাবনা করেন। এ-লক্ষ্যেই ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে দলটি অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। আর দলকে অসাম্প্র্রদায়িক করার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালান মওলানা ভাসানী। কিন্তু তাতে বাদ সাধেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তার শঙ্কা ছিল যে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিলে পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানদের নিকট দলের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাবে। কিন্তু মওলানা ভাসানীর অসাম্প্রদায়িক চেতনার যুক্তির কাছে সোহরাওয়ার্দী নতি স্বীকার করেন। কোনো শঙ্কাকে পাত্তা না দিয়ে দলে সকল ধর্ম বর্ণের মানুষদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি ছেঁটে ফেলে দলকে ধর্মীয় খোলস মুক্ত করেন। সেই থেকে স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’ ও স্বাধীনতার পর হতে অদ্যাবধি ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ নামেই সগৌরবে টিকে আছে।

লেখক: কলামিস্ট।

মানবকণ্ঠ/এআই