এক আতঙ্ক যখন আর এক আতঙ্কের কারণ হয়


- অনলাইন ডেস্ক
- ২০ মার্চ ২০২০, ০১:৪৪, আপডেট: ২০ মার্চ ২০২০, ০১:৪৫
প্রস্তুতি ছিল কিছুদিন ধরে। সচেতন থাকার বহু বারতা শুনেছি প্রতিদিন। কিভাবে করোনা থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে তার সতর্কতা বারতা মিডিয়ার মাধ্যমে পৌঁছে গেছে সাধারণ মানুষের কাছে প্রতিদিন বেশ নিয়ম করে। বাংলাদেশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর সক্রিয় এবং প্রস্তুত তেমনটাই জেনেছি। দায়িত্বশীলদের মুখে শুনেছি করোনাভাইরাসে আতঙ্কিত না হবার অভয় বাণী। রোগ নিয়ে আতঙ্কিত হতে কেউ চান না। কারণ এই মানসিক দুরবস্থা শারীরিক অবস্থাকে আরো কাহিল ও দুর্বল করে দেয়। শুধু রোগীকে নয়, রোগীকে ঘিরে যে আপন বৃত্ত থাকে তাকেও আক্রান্ত করে।
আবেগপ্রবণ জাতি বাঙালি। স্বজন, পরিজন দ্বারা বেষ্টিত থাকা জাতি। আপনজনের কিছু হলে অধীর আর অস্থির হবার বহু ঘটনার জন্ম দিয়ে ফেলে। যাইহোক। প্রথমে চীন এবং তারপর ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য থেকে এই ভাইরাস ছড়াচ্ছে গোটা বিশ্বে। এখন প্রায় প্রতিটি দেশই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। বৈশ্বিক মহামারী ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন দেশের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে বাধ্য হয়েছে নিজ দেশের মানুষের প্রাণরক্ষার জন্য। বাংলাদেশও বসে নেই। বাধ্য হয়েছে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখতে। যারা বিদেশ থেকে ফিরছেন তাদেরকে রাখা হয়েছে কোয়ারেন্টাইনে।
যেন এই ভাইরাস অন্যের মাঝে সংক্রমিত না হয়। এর ওপর কড়া সতর্কতা আরোপ করা হয়েছে। আমরা দেখছি প্রতিদিন গোটা বিশ্বে আক্রান্তদের সংখ্যা বাড়ছে, মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশেও একটা তালিকা তৈরি হয়ে গেছে। তবে যখন এই লেখা লিখছি ততক্ষণ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা দশ এবং মৃত্যুর সংখ্যা নেই। (ইতোমধ্যে ১৮ মার্চ একজন মারা গেছেন এবং সংক্রমণ বেড়েছে আরো)। ফলে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েছে। অনেক মানুষ অন্যরকম আশঙ্কা করেন, আইইডিসিআর যা বলছে তা কি সত্যি, নাকি আরো ? সঠিক তথ্য না প্রকাশের অনেক অতীত অভিজ্ঞতা সাধারণ মানুষকে অনেক কিছু ধারণা করতে সহায়তা করে।
এর সাথে যুক্ত হয়েছে নতুন আতঙ্ক, অন্যান্য রোগে আক্রান্তদের স্বাভাবিক চিকিৎসা না পাবার ভয়, আতঙ্ক। জ্বর বা গলা ব্যথা শুধু করোনা ভাইরাসের উপসর্গ নয়। টনসিলাইটিস হলেও জ্বর হতে পারে। নিউমোনিয়া হলেও তা। সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে দুটো ঘটনা ভাইরাল হয়েছে যা করোনার ভাইরাসের চাইতেও মর্মান্তিক এবং এই আতঙ্ক এখন ঘরে ঘরে, মুখে মুখে।
কানাডা থেকে আসা একজন তরুণী প্রচণ্ড পেটে ব্যথা নিয়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হলে সে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ভেবে চিকিৎসক, সিস্টারদের কাছ থেকে উপযুক্ত চিকিৎসা পাননি। হাসপাতালে করোনা ভাইরাস পরীক্ষার কিট না থাকায় আইইডিসিআর এ তার নমুনা পরীক্ষা করিয়ে আনতে আনতে চিকিৎসা না পেয়ে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
পরে জানা যায় সে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত নন। তার খাদ্যনালিতে ছিদ্র ছিল। আরেকটি ঘটনা। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত একজন হাসপাতালে যেয়ে চিকিৎসা পাননি। কারণ তিনি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত কিনা এটা জানা কোনোভাবে সম্ভব ছিল না হাসপাতালের। সেটা জানবার ব্যবস্থা ছিল না বলেই। ফলে তিনিও মৃত্যু কোলে ঢোলে পড়েন। এমন অবস্থা সৃষ্টি হলে সত্যিই তা দুঃখজনক। করোনা ভাইরাসে আতঙ্কিত হবার পাশাপাশি অন্যান্য রোগের চিকিৎসা না পাবার আতঙ্কটা যুক্ত হলে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে নিঃসন্দেহে। অন্যান্য রোগে আক্রান্তরা তাহলে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করবেন। এখানে সাধারণ রোগীদের সাধারণ চিকিৎসা দেবার ব্যবস্থাটা সক্রিয় ও নিশ্চিত রাখা দরকার। সক্রিয় রাখার জন্য প্রয়োজন হাসপাতালগুলোয় করোনা ভাইরাস শনাক্তের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা। পাশাপাশি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেবার জন্য চিকিৎসক, সিস্টার, ওয়ার্ডবয়দের উপযুক্তভাবে মানসিক প্রস্তুতি এনে দেয়া। ইতিমধ্যে এনে দেয়া দরকার ছিল, যা সম্ভব আইসোলেশন মাস্ক, ইউনিফর্ম ও জীবাণুমুক্ত থাকবার উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবার মধ্য দিয়ে।
যেন তারা নির্বিঘ্নে নিশ্চিন্তে চিকিৎসাসেবার কাজটি করতে পারেন। টিভিতে দেখেছি চীনের চিকিৎসকগণ কিভাবে করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসা দিয়েছেন। তারা চোখে পানি ফেলেছেন। কিন্তু ক্ষান্ত হননি। দেখেছি আক্রান্তদের সেবার উদ্দেশ্যে কিভাবে তারা প্রিয়জনের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন। এখনো দেখি ইতালিতে করোনায় আক্রান্তদের মাথায় হাত রেখে কিভাবে সেবা দিচ্ছেন। তবে উভয়ক্ষেত্রেই ছিল উপযুক্ত প্রস্তুতি আর পোশাক। আমাদের তেমন প্রস্তুতি আছে কিনা জানা নেই। হয়তো তেমন আকারে থাকা সম্ভব নয়। তবুও তো থাকা দরকার যতটুকু পারা সম্ভব। পাশাপাশি দরকার অন্যান্য রোগের চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
কিন্তু অতিসম্প্রতি ১৭ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে দেখলাম সরকারের হাতে মাত্র ১৭৩২টি কিট রয়েছে এবং আইইডিসিআরের ল্যাবরেটরিতেই শুধু পরীক্ষা হচ্ছে। মানে দাঁড়ালো আর মাত্র ১ হাজার ৭৩২ জনের নমুনা পরীক্ষা করা যাবে। ১৫ মার্চ সংবাদ ব্রিফিংয়ে আইইডিসিআরের পরিচালক বলেছিলেন করোনা ভাইরাস শনাক্তের জন্য নমুনা পরীক্ষার দুই হাজার কিট তারা এনেছিলেন। করোনা ভাইরাস যে গতিতে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে, প্রতিটি দেশকে যেভাবে আক্রান্ত করছে সেখানে ১৭ কোটি মানুষের জন্য এই অপ্রতুল কিট দুর্ভাবনায় ফেলে বৈকি। আতঙ্ক বাড়ায় বৈকি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা আরো প্রসারিত হওয়া দরকার, বাড়ানোর দরকার। যদিও আইইডিসিআর বলছে তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ একাধিক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।
তারা আশ্বাসও দিয়েছে। তবে কবে নাগাদ কিট পৌঁছাবে, তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি আইইডিসিআর পরিচালক। অন্যদিকে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে দ্রুতরোগী শনাক্ত করা দরকার বলে বার বার উল্লেখ করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এ জন্য নমুনা পরীক্ষার ওপর জোর দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারলাম আমাদের দেশে শুধুমাত্র আইইডিসিআর ল্যাবরেটরিতে এই পরীক্ষা হচ্ছে। অথচ আইইডিসিআরের মতো ল্যাবরেটরি আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্রসহ আরও একাধিক প্রতিষ্ঠানের আছে।
ভারত শুরুতে একটি কেন্দ্রে এই পরীক্ষা শুরু করলেও এখন এই পরীক্ষা করা হচ্ছে ৬২টি কেন্দ্রে। বিপুল জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশে এই অপ্রতুল কিট আর একটি মাত্র ল্যাবরেটরি কতটা করোনামুক্ত ও আতঙ্কমুক্ত রাখতে সক্ষম জনগণকে তা ভাবা দরকার। এদিকে আরো প্রস্তুতি থাকা দরকার ছিল বলে মনে করি। জনগণকে সতর্ক থাকতে বলা হচ্ছে, জনগণ সতর্ক থাকতে বাধ্য থাকবেন। প্রয়োজনে কোয়ারেন্টাইন আইন চালু করা হোক। কিন্তু সেই সাথে যে দ্রুত রোগী শনাক্ত করা দরকার। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সম্মিলিতভাবে কাজ করতে পারে।
অন্যান্য দেশে অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। যেহেতু এই ভাইরাস সংক্রমিত হয় এবং এর প্রতিষেধক এখনো আবিষ্কৃত হয়নি বিধায় সংক্রমণের হাত রক্ষা পাওয়ার জন্য সেলফ কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা বা সেলফ আইসোলেশন ব্যবস্থায় জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগে বন্ধ ঘোষণা করলেও বাংলাদেশে ১৫ মার্চ থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে যারা আওয়ামী লীগের বিপরীতে অবস্থান করছেন তারা ভাবছিলেন ১৭ মার্চের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ দেয়া হবে। সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের আহŸান জানানো হচ্ছিল। বন্ধের পরিস্থিতি এখনো হয়নি বলতে বলতে অবশেষে বন্ধের ঘোষণা এলো এবং তা ১৭ মার্চের আগেই। ১৭ মার্চ অতিক্রম হলে বিরোধী দল অনেক সমালোচনার সুযোগ পেতেন হয়তো। যাইহোক সরকারকে সাধুবাদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করবার উত্তম সিদ্ধান্ত নেবার জন্য।
পোশাকশিল্পসহ বিভিন্ন কলকারখানায় অনেক শ্রমিককে একসাথে একরুমে বসে কাজ করতে হয়। যারা হ্যান্ড স্যানিটাইজার, টিস্যু ব্যবহারে অভ্যস্থ নন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে সামর্থ্যরে কারণে তেমন একটা সচেতনও নন। কাজে প্রবেশের সময়ে তাদের শারীরিক অবস্থা ভালোমতো পরীক্ষা করানো যায় যেমন, শরীরের তাপমাত্রা, সর্দি, কাশি আছে কিনা। যদি শারীরিক অসুস্থতা ধরা পড়ে তাহলে বেতন প্রদানের ব্যবস্থা করে তাকে বাসায় বিশ্রামের পরামর্শ দেয়া দরকার।
এখানে মালিক কর্তৃপক্ষের শ্রমিকের প্রতি তাদের মানবিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দেশের প্রতিটি মানুষের প্রাণরক্ষার বিষয়টি কিছুটা হলেও সুনিশ্চিত হয়। করোনার মতো ভাইরাস থেকে রক্ষা পাবার কাজটি শুধুমাত্র সরকারের পক্ষে একা করা সম্ভব নয়। সম্মিলিতভাবে করতে হবে। বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল, ওষুধ প্রস্তত প্রতিষ্ঠান, সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে সক্ষমতার ভিত্তিতে এগিয়ে আসতে হবে।
পরিশেষে বলি, দ্রুত রোগী শনাক্ত করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। এটা না হলে করোনার প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পাবার কোনো উপায় থাকবে না। অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়বে গোটা পরিস্থিতি। এতে অন্য রোগে আক্রান্তরা করোনা ভাইরাস সন্দেহে চিকিৎসাসেবা পাওয়া থেকে বি ত হতে পারেন। করোনাসহ অন্যান্য রোগের চিকিৎসা নিতে যেন কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয় সেদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর মনিটরিং করা দরকার। চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তির আরো ব্যাপক প্রস্তুতি অতিসত্বর দরকার। সর্বাগ্রে প্রয়োজন চিকিৎসক ও সেবকসেবিকাদের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসাসেবার জন্য প্রস্তুত করে তোলা, যেন তারা স্বচ্ছন্দে সেবা দিতে পারেন। তাহলে সম্ভবত করোনা আতঙ্ক কমবে।
- লেখক: কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক
মানবকণ্ঠ/এমএইচ
