মরণব্যাধি করোনা ভাইরাস

- ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০১:৪১, আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১০:২৬
সারাবিশ্ব বর্তমানে মরণব্যাধি করোনা ভাইরাসের ভয়ে কাঁপছে। এটি দিনে দিনে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। ভাইরাস জগতে অগণিত প্রজাতির ভাইরাস বিদ্যমান। আর এর মধ্যে প্রায় দুই হাজার করোনা ভাইরাস আবিষ্কৃত তথা চিহ্নিত হয়েছে। তবে সব ভাইরাস অতটা খারাপ না হলেও কিছু কিছু ভাইরাস খুবই মারাত্মক।
ইতোমধ্যে করোনা প্রজাতির সর্বশেষ এই ভাইরাসটির আবির্ভাব হয়েছে, যা করোনা’ ২০১৯-nCov virus বলে অভিহিত। এটি এখন বিশ্ববাসীর প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন স্বভাবতই একটি প্রশ্ন জাগতে পারে যে, এর নাম করোনা ভাইরাস হলো কীভাবে? করোনা (corona) ইংলিশ শব্দ; যা এসেছে লাতিন ভাষা থেকে আর ইংরেজ corona এর আভিধানিক অর্থ হলো সূর্য বা চন্দ্রের চারদিকে যেমন রশ্মি ছড়িয়ে একটি প্রপ মূলক প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি করে। ঠিক এ প্রজাতির অধিকাংশ ভাইরাস সেই রকম দেখতে বিধায় এর নামকরণ করা হয়েছে ‘করোনা ভাইরাস’।
সার্স, বার্ড ফ্লু, নিপা, জিকা, চিকুনগুনিয়া ইত্যাদি ভাইরাসের তাণ্ডব শেষ হতে না হতেই এখন আবার এই নতুন মরণব্যাধি করোনা ভাইরাসের ব্যাপারে বিশ্ববাসী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, চীনসহ বিভিন্ন দেশে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার মূল উৎসই হচ্ছে বিষধর চীনা ক্রেইট এবং কোবরা সাপ।
তাছাড়া করোনা ভাইরাস বাতাসে মিশে প্রাথমিকভাবে স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখির শ্বাসযন্ত্রে সংক্রমণ করে থাকে। এর ফলে প্রাথমিকভাবে জ্বর, সর্দি ও শ্বাসকষ্ট উপসর্গ হিসেবে দেখা দেয়। অবশ্য এ ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগের কারণ হলো, সিভিয়ার অ্যাকুইট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (সার্স)। এই ভাইরাস জীবজন্তু বা মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ছে। যতদূর জানা যায়, তাতে প্রতীয়মান হয় যে, ভাইরাসটির উৎস কোনো প্রাণী বা জীবজন্তু।
ভাইরাসটি গত বছর (২০১৯) ৩১ ডিসেম্বরের দিকে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান শহরের মাছ, মাংস, জীবজন্তু ও শাকসবজির একটি কাঁচাবাজারে প্রথম ধরা পড়ে আর এটি যেনতেন ভাইরাস নয়, বিগত সব ভাইরাসের থেকেও মারাত্মক এবং জীবনঘাতী। এটি ধীরে ধীরে মহামারী আকার ধারণ করার অবস্থা দেখে ইতোমধ্যে জাতিসংঘ বিশ্বব্যাপী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে ওই ভাইরাসের কারণে সারাবিশ্বে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে আর চীনের আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরো মারাত্মক রূপ পরিগ্রহ করছে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, এক্ষেত্রে সেই মানবতাবাদী চিকিৎসক লি ওয়েনলিয়াংওয়ের কথা মনে পড়ে যায়। তিনিই বিগত সালের ৩০ ডিসেম্বর সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়ায় চীনা কর্তৃপক্ষ মুচলেকা নিয়ে তার মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলে অথচ তার কথাই শতভাগ সত্য হয় আর দুঃখের বিষয় হলো যে, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত এই স্বনামধন্য চিকিৎসককে ১২ জানুয়ারি ২০২০-এ হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও সবাইকে কাঁদিয়ে অকালে মৃত্যু হয়।
যেহেতু এটি জ্বর, সর্দি ও শ্বাসকষ্ট ভাইরাসজনিত রোগ। সেহেতু এ বিষয় সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়ার জন্য ভাইরাসসংক্রান্ত সাধারণ জ্ঞান থাকা আবশ্যক বলে মনে করি। মনে রাখতে হবে যে করোনা ভাইরাস সেই ভাইরাস, যা ভাইরাস মানব শরীরে ঢোকার পর সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিতে প্রায় পাঁচ দিন লাগে। প্রথম লক্ষণ হচ্ছে জ্বর, তৎপর দেখা দেয় হাঁচি এবং সঙ্গে শুকনো কাশি। আর এক সপ্তাহের মধ্যে দেখা দেয় শ্বাসকষ্ট। এর পেছনে কারণ হলো- ফুসফুসে সংক্রমণ ধীরে ধীরে বেড়ে শ্বাসকষ্ট বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং একই সঙ্গে বুকে ব্যথা হয়। তবে বুকের ব্যথার ধরন একেবারেই আলাদা।
কেননা গভীর বা লম্বা শ্বাস নেয়ার সময়ে বুকে ব্যথা বা চাপ অনুভত হয়। বস্তুত ফুসফুসে সংক্রমণজনিত প্রদাহের কারণে এই ব্যথা হয়। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক কম, তাদের জ্বÍর নাও হতে পারে; যেমন যারা বৃদ্ধ; যারা ধূমপান করেন; যাদের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস; যারা ইতোপূর্বে ফুসফুসে আঘাত পেয়েছিলেন; যাদের ক্যান্সারের কারণে কেমোথেরাপি দিতে হয়; তাছাড়া কোনো জটিল রোগের জন্য লাগাতার ওষুধ খাওয়ার কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়েছে এবং এ ধরনের অন্য কোন সমজাতীয় অবস্থার ব্যক্তিরা এর আওতাভুক্ত।
এটা লক্ষণীয় যে এসব মানুষের ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি আর এ পর্যন্ত যত লোক মারা গেছেন, তার শতকরা আশি ভাগ মানুষের বয়স ৬০ বছরের ওপরে। মজার ব্যাপার হলো যে, এই ভাইরাসের বিস্ফোরণ ঘটে আচমকা। এর শুরুটা হয় সর্দি-কাশি ও জ্বর দিয়ে। তৎপর ধীরে ধীরে শ্বাসকষ্ট বাড়ে আর আক্রান্ত ব্যক্তি ডাবল নিউমোনিয়ার দিকে এগিয়ে যায়। অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা দেয় সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম, যা ছড়িয়ে পড়ে গোটা শরীরে এবং এর ফলে কিডনিসহ দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে পড়ে এবং পরিণামে অবধারিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। কোনো ব্যক্তির মধ্যে যদি এই ভাইরাসজনিত রোগের লক্ষণ বলে প্রতিভাত হয়, তাহলে ন্যূনতম তাকে ১৪ দিন আইসোলেশন পিরিয়ড ভিত্তি করে পর্যবেক্ষণে রাখা জরুরি।
এদিকে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসের ওষুধ বা চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি। তাই এক্ষেত্রে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের বিষয়টি অনুসরণ তথা প্রতিপালন করা ছাড়া গত্যন্তর দেখি না। সেহেতু ঘর থেকে যখন কাজের উদ্দেশ্যে বাইরে বের হতে হবে; তখন মাস্ক ব্যবহার করতে গাফিলতি করা যাবে না এবং ঘরে ফিরে এসে সাবান বা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে উত্তমভাবে হাত-মুখ ধুতে হবে। এক্ষেত্রে ন্যূনতম বিশ সেকেন্ড ধরে পরিষ্কার করতে হবে। খামার বা গোয়াল ঘর কিংবা বাজারে সে সব জায়গায় গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি থাকে, সে সব স্থান এড়িয়ে চলতে হবে। একান্ত প্রয়োজনবোধে যদি পশু-পাখি স্পর্শ করতে হয়। তখন পুনরায় ভালোভাবে হাত-মুখ পরিষ্কার করতে হবে।
রান্না বা খাওয়ার পূর্বে শাকসবজি, ফলমূল, মাছ-মাংস উত্তমভাবে ধৌত করতে হবে আর ডিম বা মাংস রান্না করার প্রাক্কালে ভালো করে সিদ্ধ করে নিতে হবে। ময়লা কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করে উচ্চ তাপমাত্রায় তা শুকাতে হবে এবং যতটা সম্ভব গণজমায়েত বা গণপরিবহন এড়িয়ে চলা বিধেয় আর অপরিষ্কার হাতে চোখ, মুখ ও নাক স্পর্শ করা যাবে না। আক্রান্ত হলে বিশ্রামসহ প্রচুর পানি পান করতে হবে এবং একই সঙ্গে নিকটস্থ হাসপাতাল বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে যে মুখ-গহ্বর ও গলনালি কোনো সময় যেন শুকনো না থাকে, সে ব্যাপারে সদা সচেষ্ট থাকতে হবে।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এই ভাইরাস মহামারীরূপ নিয়ে চীনসহ ২৮টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই এই মর্মে আশঙ্কা জাগে যে, বাংলাদেশে যদি এই ভাইরাস ঢোকে, তাহলে কী যে অবস্থা হবে, তা কেবল ভবিতব্যই বলতে পারে। কেননা এই ঘনবসতি বহুল দেশের প্রায় লোক স্বাস্থ্যসচেতন নয়। তবে বাংলাদেশ এ ব্যাপারে সতর্ক অবস্থা অবলম্বন করেছে। এ প্রেক্ষিতে চীন থেকে ফিরে আসা লোকসহ স্থানীয়ভাবে সবরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, প্রাণঘাতী এই ভাইরাস প্রতিরোধে ব্যাপক ও জোরদার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বর্তমান সরকার। এ লক্ষ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বেশ কিছু আগাম পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশের সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আলাদা ওয়ার্ড প্রস্তুতসহ নানা কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। অনেক বিশেষজ্ঞ ধারণা করছেন যে, এটি সত্যিই মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়লে বিশ্বজুড়ে ন্যূনতম ৬ কোটি লোক নাকি প্রাণ হারাবে কিন্তু এটা থেকে উত্তরণের জন্য জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিসহ জীববিজ্ঞানীরাও বসে নেই। এর মধ্যে করোনা ভাইরাস আক্রান্তদের চিকিৎসায় আশার আলো দেখিয়েছেন থাইল্যান্ডের চিকিৎসকরা। তারা দাবি করছেন, ফ্লু এবং এইচআইভি ভাইরাসের ওষুধের মিশ্রণ প্রয়োগ করে নাকি সাফল্য পাওয়া গিয়েছে।
এ ব্যাপারে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের রাজাভিথি হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলেন যে, কয়েকজন রোগীর চিকিৎসায় এ ওষুধের মিশ্রণ প্রয়োগ করে তাদের উন্নতি ঘটানো সম্ভব হয়েছে, যাদের মধ্যে উহান শহর থেকে আসা আক্রান্ত ৭০ বছর বয়সী এক চীনা মহিলাও ছিলেন। এক্ষেত্রে আরো উল্লেখ্য, হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ক্রিয়াঙ্কস আতিপরনাচি বলেন যে, এই ওষুধের মিশ্রণ প্রয়োগে রোগীদের অবস্থার অনেকাংশে উন্নতি হয়েছে। কেননা এই রোগীদের দেহে ওষুধের মিশ্রণ প্রয়োগের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই আর করোনা ভাইরাস পাওয়া যায়নি।
তবে এটাই মানসম্পন্ন চিকিৎসা কি না তা নির্ধারণে আরো গবেষণা অব্যাহত আছে। পরিশেষে এই বলে শেষ করছি, এ পর্যন্ত এই মরণব্যাধির কোনো সঠিক প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। তাই প্রতিরোধের (prevention) ওপরই গুরুত্ব দিতে হবে এবং জীবনযাপনের প্রাক্কালে এই নোভেল ভাইরাসের নেতিবাচক বিষয়াদি চিন্তা-ভাবনা করে স্বাস্থ্য সচেতন থাকা কেবল সমীচীনই নয়, জীবনের স্বার্থে জরুরিও।
- লেখক: মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব- গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।
মানবকণ্ঠ/এমএইচ


