নিউ মার্কেট সংঘাত

পাল্টাপাল্টি দোষারোপে উত্তাপ

দোকান কর্মচারীদের হয়ে সংঘর্ষে জড়ানো তিন ছাত্রলীগ কর্মী চিহ্নিত


  • শাহীন করিম
  • ২১ এপ্রিল ২০২২, ১৫:৪৭,  আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০২২, ১৫:৫৫

রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। দোকান খোলার প্রস্তুতি ও ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে সংঘর্ষের জন্য ছাত্রদের একতরফা দায়ী করার খবরে গতকাল বুধবার বিকালে ওই এলাকায় ফের উত্তেজনা দেখা দেয়। আগের দিন ব্যাপক সংঘর্ষের পর নিউ মার্কেট এলাকার ব্যবসায়ীরা যখন সাদা পতাকা উড়িয়ে দোকান খুলতে শুরু করে, তখন বেশ কয়েকটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটেছে ঢাকা কলেজের সামনে। ছাত্র-দোকানিরা সড়কে নামলে ও বিস্ফোরণের ঘটনায় কিছু সময়ের জন্য যান চলাচল বন্ধ থাকে। পরে পুলিশ, শিক্ষক ও ব্যবসায়ীদের নেতাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।

ঘটনার জন্য একে অপরকে দায়ী করে পাল্টা-পাল্টি অভিযোগ করেছেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীরা। এদিকে ঘটনার শুরুতে নিউ মার্কেটে যাওয়া তিন ছাত্রলীগের তিন কর্মীকে শনাক্ত করা হয়েছে। সমঝোতার জন্য গতকাল রাতে কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী নেতারা। তবে গতকাল বিকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গণমাধ্যমকে বলেন, নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী ও ঢাকা কলেজের ছাত্রদের নিয়ে সৃষ্টি পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত অনুকূলে আছে। যদি এ রকম পরিস্থিতি থাকে তবে সব দেখে আমরা মার্কেট খুলে দেব।

এরআগে গত সোমবার রাতে নিউ মার্কেটে সংঘর্ষের শুরুতে অংশ নেয়া ঢাকা কলেজের তিন ছাত্রলীগ কর্মী লিটন, মাসউদ ও নাসিমকে শনাক্ত করা হয়েছে। একাধিক সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণে দুই খাবার দোকানের বিবাধকে ঘিরে পরবর্তীতে সংঘর্ষের সূত্রপাতের সঙ্গে এই তিনজনের সরাসরি সম্পৃক্ততার তথ্য মিলেছে। তারা মারামারি করতে গিয়ে এক পর্যায়ে নিজেরাই মার খেয়ে ক্যাম্পাসে ফিরে ছাত্রদের মিথ্যা তথ্য দিয়ে খ্যাপিয়ে তোলে। একইভাবে সংঘর্ষের ঘটনায় কয়েকজন সহিংস দোকানি কাম ব্যবসায়ীকে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য কারা দায়ী- তা জানতে কমপক্ষে ১০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। এদের অনেকেই দোকান কর্মচারী।

এদিকে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ এ টি এম মইনুল হোসেন দাবি করে বলেছেন, তার কলেজের শিক্ষার্থীরা সংঘর্ষের সময় কোনো দোকানে আগুন দেয়নি। বরং ছাত্রদের ওপর হামলা করেছে দোকানিরা। ছাত্ররা জড়িত ছিল না, জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। পুলিশ বাড়াবাড়ি করেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে ডিএমপির রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) সাজ্জাদুর রহমান বলেনছেন, ঘটনাটি আমরা তদন্ত করছি। এ পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। রাতে মামলা হলে বিস্তারিত তুলে ধরা হবে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল গণমাধ্যমকে বলেছেন, নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী ও ঢাকা কলেজের ছাত্রদের নিয়ে সৃষ্টি পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত অনুকূলে আছে। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে আমরা মার্কেট খুলে দেব।

এদিকে সোমবার রাতে শুরু হওয়া ব্যবসায়ী ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ মঙ্গলবার দিনভর রূপ নেয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। ব্যবসায়ী-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে চলা সংঘর্ষে শতাধিক আহত হয়েছেন। মঙ্গলবারের সংঘর্ষে নাহিদ নামে একজন পথচারী নিহতও হয়েছেন। মঙ্গলবারের রক্তক্ষয়ী সংঘাত পেরিয়ে গতকাল ঢাকা কলেজের সামনের কয়েকটি বিপণিবিতানে সাদা পতাকা উড়িয়ে দোকান খোলা শুরু হয়েছিল। মিরপুর সড়কেও গাড়ি চলাচল করছিল। তবে বিকালে ঢাকা কলেজের সামনে অন্তত এক ডজন হাতবোমার বিস্ফোরণের পর দোকানগুলো বন্ধ হয়ে যায়। সড়কে গাড়ি চলাচলও বন্ধ থাকে ঘণ্টাখানেক। পথচারীরা সরে পড়ে নতুন করে সংঘর্ষ বাঁধার শঙ্কায়। বিকাল ৪টা ৪০ মিনিটের দিকে ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতরে ও বাইরে পরপর ১০-১২টি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটে। দুটি বিস্ফোরণ ঘটে কলেজের সামনে সড়কের ওপর। এই বিস্ফোরণ কারা ঘটিয়েছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে বিস্ফোরণের সময় ঢাকা কলেজের ফটকের সামনে জড়ো হয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের হাততালি দিতে দেখা গেছে।

দোকান কর্মচারীদের হয়ে সংঘর্ষে জড়ানো তিন ছাত্রলীগ কর্মী চিহ্নিত: নিউ মার্কেটে দুই দোকান কর্মচারীর ঝগড়ায় একজনের পক্ষ হয়ে ঢাকা কলেজের যে সব শিক্ষার্থী নিউ মার্কেটে মারামারিতে জড়িয়েছিল তাদের তিনজনকে চিহ্নিত করা গেছে। তারা মারামারি করতে গিয়ে এক পর্যায়ে নিজেরাই মার খেয়ে ক্যাম্পাসে ফিরে ছাত্রদের মিথ্যা তথ্য দিয়ে খ্যাপিয়ে তোলে। এ সময় হেলমেট পরা শিক্ষার্থীরাও ভাংচুর চালায়।

ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় ফুটে উঠেছে এসব চিত্র। সোমবার সন্ধ্যায় ইফতারির টেবিল সাজানো নিয়ে পাশের ক্যাপিটাল ফাস্টফুডের কর্মচারী কাওসারের বিবাদ শুরু। যা এক পর্যায়ে সহিংস হয়ে উঠেছিল। পরে রাত সাড়ে এগারোটায় বাপ্পী ঢাকা কলেজ থেকে তার পরিচিতদের নিয়ে আসেন। যারা এসে ক্যাপিটালের কাওসার ও বাবু নামের দুই কর্মচারীকে মারতে শুরু করে। এক পর্যায় বাবুকে মাথায় সূচালো কিছু একটা দিয়ে আঘাত করা হয়। একই সময় প্রথমে ইট দিয়ে বাপ্পীকে ও পরে দোকানের চাপাতি এবং ছুরি দিয়ে পাল্টা হামলা চালায় ক্যাপিটালের কর্মচারীরা। খালি গায়ে থাকা এক কর্মচারী ধারালো কিছু একটা দিয়ে বাপ্পীর সমর্থকদের কোপ দেয়।

এই মারামারিতে ঢাকা কলেজের তিন শিক্ষার্থীকে চিহ্নিত করা গেছে। এরা হলেন নাসিম, মাসুম ও লিটন। তিনজনই ঢাকা কলেজের ফরহাদ হলের ছাত্র। এই মারামারিতেই নাসিমের গায়ে কোপ লাগে। এরা ছাত্রলীগের কর্মী বলে অন্য ছাত্ররা জানায়। ধাওয়া খেয়ে ক্যাম্পাসে গিয়ে তারা জানায় কেনাকাটা করতে যাওয়ার পর নিউ মার্কেটের দোকানিরা তাদের ওপর হামলা করেছে। এই খবরেই দলে দলে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা হেলমেট পরে বের হয়ে নিউ মার্কেট, ধানমণ্ডি হকার্সে ব্যাপক ভাংচুর শুরু করলে সংঘর্ষটি নিউ মার্কেট বনাম ঢাকা কলেজে রূপ নেয়।

অন্যের ঘাড়ে দায় চাপালো দোকান মালিক সমিতি: নিউ মার্কেট ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃষ্ট পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ সমাধান চেয়েছে দোকান মালিক সমিতি। ভবিষ্যতে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে যাতে কোনো সংঘর্ষ না ঘটে সেজন্য ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও প্রশাসনকে নিয়ে কমিটি গঠনের কথাও জানিয়েছে দোকান মালিকদের এ সংগঠন। একই সঙ্গে নিউ মার্কেটে অ্যাম্বুলেন্সে হামলায় তৃতীয় পক্ষ জড়িত বলে দাবি করেছেন সংগঠনটির নেতারা।

গতকাল দুপুরে নিউ মার্কেট সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান নিউ মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ডা. দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন। তিনি বলেন, সংঘর্ষের ঘটনায় আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করে দোষীদের চিহ্নিত করব। আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টি মীমাংসার আশ্বাস দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, দুই পক্ষের আলোচনার মধ্যে খুব শিগগিরই দোকান খোলা হবে। এদিকে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির নেতা হেলাল উদ্দিন দাবি করেছেন, মঙ্গলবার নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষ চলাকালে অ্যাম্বুলেন্সে হামলার যে ঘটনা ঘটেছিল তাতে নিউ মার্কেটের কেউ জড়িত ছিল না। সেখানে তৃতীয় পক্ষ হামলা চালিয়েছে। ভিডিও ফুটেজ দেখলেই বিষয়টা স্পষ্ট হবে।

মানবকণ্ঠ/এআই


poisha bazar