

যে ধ্রুব পদ দিয়েছে বাঁধে বিশ্বতানে
তাই মিলাব কথা জীবন গানে।
বিমল নীল,
হৃদয়ে লব তারাটি মিল,
শান্তিময়ী গভীর বাণী নীরব প্রাণে।।
* ঠাকুর পরিবারের আদি পদবি ছিল কুশারী। তাঁরা ছিলেন শাণ্ডিল্য গোত্রের ব্রাহ্মণ। আগেকার দিনে নীচু শ্রেণির হিন্দুরা ব্রাহ্মণদের অনেক সময় ঠাকুর বলতেন, এইভাবেই তাঁদের পদবি ঠাকুর হয়ে যায়।
* বালক রবীন্দ্রনাথ বাড়িতে পড়াশোনা, গান ও আঁকা শেখা ছাড়াও প্রায় প্রতিদিন ভোরে উঠে তখনকার বিখ্যাত কুস্তিগির হিরা সিং-এর কাছে কুস্তি শিখতেন।
* রবীন্দ্রনাথের ঘুম ছিল খুব কম। গভীর রাতে শুতেন, উঠতেন শেষ রাতে। সাধারণত তাঁর দিন শুরু হতো স্নানান্তে উপাসনায়। ঠিক ভোর চারটেতে চা। চারটে থেকে সাতটা পর্যন্ত একটানা লিখতেন। সাতটায় প্রাতরাশ সেরে আবার লেখা। ফাঁকে ফাঁকে চা বা কফি।
* রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় বা একই বাড়িতে বেশিদিন থাকতে পারতেন না। কখনো জোড়াসাঁকো, কখনো বা শান্তিনিকেতন, কখনো চন্দননগর, কখনো বা কালিম্পং। কলকাতাতে থাকার সময় সদর স্ট্রিট, গুরুসদয় দত্ত রোড, বরানগরে প্রশান্ত মহলানবিশের বাড়ি আম্রপালি, আবার কখনো নিজের বাড়ি জোড়াসাঁকোতে থাকতেন। শান্তিনিকেতনে তাঁর থাকার জন্যেই একে একে তৈরি হয়েছিল কোনার্ক, শ্যামলী, উদয়ন, পুনশ্চ, দেহলি, উদীচী নামে নানা বাড়ি।
* নিজের খেয়ালে তিনি নিজের ঘর সাজাতেন, ব্যবহার করতেন নানা ধরনের সামগ্রী। একবার পঁচিশ তিরিশটি কম্বল দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন বিছানা, চেয়ার, টেবিল, মেঝে, দেওয়াল সবকিছু। আর একবার লোহার শিক ব্যবহার করেছিলেন। একবার খাট, চেয়ার, টেবিল, ডেস্ক তৈরি করিয়েছিলেন সিমেন্ট দিয়ে।
* তিনি বাড়িতে পরতেন গেরুয়া বা সাদা রঙের জোব্বা আর পায়জামা। উপাসনা বা সভা-সমিতিতে যাওয়ার সময় জোব্বা ছাড়াও সাদা ধুতি, জামা ও চাদর ব্যবহার করতেন। ঋতু উৎসবে ঋতু অনুযায়ী নানা রঙের রেশমি উত্তরীয় ব্যবহার করতেন। যেমন বর্ষায় কালো বা লাল, শরতে সোনালি, বসন্তে বাসন্তী রঙের। কখনো কখনো জোব্বার রঙও হতো উত্তরীয়র রঙের।
* চমৎকার কাঠামোয় তিনি ছিলেন নীরোগ দেহের অধিকারী। তবে মধ্য তিরিশে সামান্য ক্ষীণদৃষ্টির কারণে চশমা নিতে হয়েছিল। ৬৭ বছর বয়সে প্রথম বড় ধরনের চিকিৎসা করতে হয়েছিল প্রস্রাবের উৎপাতে। ৭৬ বছর বয়সে ইরিসিপেলাস-এর আক্রমণ, মাঝে মাঝে কোমরে ব্যথা। ৭৯ বছরে মূত্রাশয়ের পীড়া, ৮০ বছরে প্রস্টেট অপারেশন। তবে মাঝে মাঝে ভুগিয়েছে অর্শ আর শেষ জীবনে দৃষ্টি হয়েছে ক্ষীণ, কানেও শুনতেন কম।
* বৃক্ষপ্রেমী রবীন্দ্রনাথের গানে কবিতায় ছড়িয়ে আছে অসংখ্য উদ্ভিদ আর ফুলের নাম। শুধু কাব্যেই উল্লেখ আছে ১০৮টি গাছ ও ফুলের নাম। এর মধ্যে বেশ কিছু বিদেশি ফুলের বাংলা নাম দিয়েছিলেন কবি স্বয়ং। তাঁর দেওয়া কয়েকটি ফুলের নাম হলো : অগ্নিশিখা, তারাবারা, নীলমণিলতা, বনপুলক, বাসন্তী।
* ১৯১৬ সালে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং ১৯২৬ সালে হাঙ্গেরিতে তিনি স্বহস্তে বৃক্ষরোপণ করলেও শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণ উৎসব আনুষ্ঠানিক প্রবর্তন করেন ১৯২৮ সালে। এর কুড়ি বছর পর সরকারি তৎপরতায় বনমহোৎসব সর্বভারতীয় উৎসব হিসেবে মর্যাদা লাভ করে।
* অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধির শান্তিনিকেতনে এসে কবিকে ‘ডক্টর’ উপাধি দিয়েছিলেন ১৯৪০-এর ৭ আগস্ট।
* নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তাঁকে বোলপুরে বিশেষ সংবর্ধনা জানাবার জন্যে কলকাতার বিদগ্ধজনদের নিয়ে হাওড়া থেকে একটি বিশেষ ট্রেন ছাড়ে ১৯১৩ সালের ২৩ নভেম্বর তারিখে সকাল ১০টা ১১ মিনিটে। ওই ট্রেনের যাত্রীদের জন্যে ব্যবহার করা হয়েছিল একটি বিশেষ ট্রেনের টিকিট।
* রবীন্দ্রনাথ বেশ ভালো সাঁতার জানতেন। পুত্র রথীন্দ্রনাথকে তিনিই সাঁতার শেখান। হঠাৎ বোটের ওপর থেকে নদীতে তাঁকে ফেলে দিয়ে। রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘গোরাই নদীর এপার ওপার করতে তাঁকে অনেকবার দেখেছি।’
* রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে প্রথম ‘বিশ্বকবি’ কথাটি বলেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়। তাঁর নিজের সম্পাদনায় প্রকাশিত সোফিয়া পত্রিকায় ১৯০০ সালে তিনি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এর নাম ছিল ‘দ্য ওয়ার্ল্ড পোয়েট অফ বেঙ্গল’।
* রবীন্দ্রনাথকে চীন থেকে ১৯২৪ সালে চু-চেন-তান উপাধি দেওয়া হয় তার ‘অর্থ’, ‘বজ্রপ্রভাত’। ১৯৩১-এ সংস্কৃত কলেজ তাঁকে ভ‚ষিত করে ‘কবি সার্বভৌমা উপাধিতে। ১৯৩৯-এ পুরীর রাজা তাঁকে ‘পরমগুরু’ উপাধি দেন আর ত্রিপুরারাজ তাঁকে ‘ভারতভাস্কর’ উপাধি দিয়েছিলেন ১৯৪১ সালে।
* ভানুসিংহ ঠাকুর যে রবীন্দ্রনাথের ছদ্মনাম ছিল সেটা অনেকেরই জানা। তাঁর আরো কয়েকটি ছদ্মনাম : দিকশূন্য ভট্টাচার্য, অপ্রকটচন্দ্র ভাস্কর, আন্নাকালী পাকড়াশি।
* শিলাইদহে প্রতিষ্ঠিত হয় মহর্ষি দাতব্য চিকিৎসালয়। চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে হোমিওপ্যাথি, কবিরাজি, অ্যালোপ্যাথি- তিন রকমই চালু ছিল। কুইনিন বিলি করা হতো বিনামূল্যে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও হোমিওপ্যাথি পদ্ধতিতে চিকিৎসা করতেন।
* রবীন্দ্রনাথ বাংলা ছোটগল্পের পথিকৃৎ। তার আগে কেউ বাংলাতে সেভাবে ছোটগল্প লেখেননি। ১৮৭৭ সালে ‘ভিখারিণী’ নিয়ে তাঁর ছোটগল্প লেখার শুরু, শেষ ১৯৪১-এ ‘প্রগতি সংহার’ লিখে। দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে তাঁর ছোট গল্প লেখা চলেছে অন্যান্য সব কিছু লেখার সঙ্গে।
* রবীন্দ্রনাথের কাছে নানাজন চিঠি লিখতেন, প্রশ্ন করতেন জীবন, সমাজসমস্যা নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ সাধ্যমত উত্তর দিতেন। নিজের প্রয়োজনেও চিঠি লিখতেন। আজ পর্যন্ত প্রায় বেয়াল্লিশশো মতন চিঠি লিপিবদ্ধ হয়েছে।
* রবীন্দ্রনাথের প্রথম গান রেকর্ডে গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই। ‘কৃন্তলীন’ খাত হেমেন্দ্রনাথ বসু তার ‘এইচ বোসেজ রেডর্ক-এ রবীন্দ্রনাথের গাওয়া গানগুলি যন্ত্রবদ্ধ করেন চোঙাকৃতি মোমের তৈরি ‘সিলিন্ডার রেকর্ড’-এ। এই রেকর্ড বাজান হত ফোনোগ্রাফ যন্ত্রে।
* নিজের লেখা নাটকে রবীন্দ্রনাথ প্রথম অভিনয় করেছিলেন ‘বাল্মীক প্রতিভা’য় বাল্মীকির ভ‚মিকায়। নাটকটি মঞ্চস্থ হয় জোড়াসাঁকোয় ১৮৮১ সালের ২৬ ফেব্রæয়ারি।
* রবীন্দ্রনাথের কাহিনি নিয়ে বেশ কয়েকটি যাত্রাও হয়েছে। প্রথম যাত্রাপালা মঞ্চস্থ হয় তার ‘মস্তক বিক্রয়’ কাহিনি অবলম্বনে ‘প্রতিশোধ’। চন্ডী অপেরা শুরু করলেও যাত্রাটির প্রথম সার্থক অভিনয় করে নট্ট কোম্পানি ১৯৫৩ সালে। যাত্রাটির পালারূপ দিয়েছিলেন ব্রজেন্দ্রকুমার দে এবং পরিচালনা করেছিলেন অমিয় বসু।
* অনেক আগে আঁকা শুরু করলেও রবীন্দ্রনাথ নিয়মিত ছবি আঁকতে শুরু করেন ১৯২৮ সালে, যখন তার বয়স ৬৭।
* দেশ বিদেশের বহু শিল্পী রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি এঁকেছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রথম ছবি আঁকেন তার দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ১৮৮১ সালে।
* রবীন্দ্রনাথ তার পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও বন্ধুপুত্র সন্তোষ মজুমদারকে আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন কৃষি ও পশুপালন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য। তারা ফিরে এসে শিলাইদহে ও পতিসরে বসানো হয় আদর্শ কৃষিক্ষেত্রÑ ৮০ বিঘা জমি জুড়ে। তারা ১৯১০ সালে কৃষিক্ষেত্রের ট্রাক্টর আর পাম্পসেট চালান। বসানো হয় কৃষি ল্যাবরেটারি।
* ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ স্থাপন করেন ‘পতিসর কৃষিব্যাঙ্ক’ নোবেল প্রাইজের এক লক্ষাধিক টাকা তিনি ব্যাঙ্কে ঢালেন। এখান থেকে কৃষকদের স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া হতো। ব্যাঙ্ক চলেছিল কুড়ি বছর।
মানবকণ্ঠ/এআই