

বিলকিস ঝর্ণা: চড়াই উৎরাই পেরিয়ে বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ১৯২৮ সালে চিত্রকর হিসেবে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব হয় অনেকটা ধূমকেতুর মতো। বিশ্ব বরেণ্য রবীন্দ্রনাথ এই চিত্রশিল্পে সমসাময়িক সমস্যার বেড়াজাল - স্বাধীকার আন্দোলনের সংকটাপন্ন পরিস্থিতি এবং ভারতবর্ষের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেননি। তাঁর শিল্পচর্চার বার্তা প্রসারিত হয়ে বর্তমানের উঠোন পেরিয়ে আলোড়িত করেছে সুদূর ভবিষ্যতের চিত্রশিল্প চর্চায় আবিষ্ট এই প্রজন্মকে। রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা তাই এ যুগের চিত্রশিল্পীদের অনুপ্রেরণা এবং বিশ্লেষণের বিষয়ও।
পৃথিবীর সকল দেশের ক্ষেত্রেই সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনের ক্রান্তিলগ্নে সে দেশের শিল্প এবং সাহিত্যের ভাষার চরিত্র বদলে যায়। চিত্রকলাও এক ধরনের সাহিত্যেক ভাষা এবং শিল্প। যেখানে উঠে আসে গতিশীল সমাজের স্পষ্ট প্রতিবিম্ব। চিত্রকলার মাধ্যমেই আবিষ্কৃত হয় গুহা মানবের জীবন জীবিকার প্রকৃতি। চিত্রকলাও মূলত সময়েরই নির্মোহ প্রতিবিম্ব। কাজেই সেসময় চিত্র কলারও বড় রকমের পট পরিবর্তন ঘটে। পরিবর্তন ঘটে তার প্রকাশ ভঙ্গি ও বক্তব্যে। আর তখন সাহিত্য সৃষ্টির ধারায় ভারত বর্ষের চিত্র শিল্পেও এক নতুন দিগন্ত জুড়ে দেন রবীন্দ্রনাথ।
আমরা উপন্যাস - দর্শন- বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আমাদের পাণ্ডিত্য জাহির করতে এতটুকুও কুণ্ঠা বোধ করিনা। বরং তা গৌরবের সঙ্গে বলতে ভালোবাসি। অথচ ---‘ছবিটবি তেমন বুঝিনা বলতে’ এতটুকু সংকোচ বোধ করিনা। এমন কি এর সঙ্গে তাচ্ছিল্যের ভাবই সোৎসাহে মিশ্রিত থাকে। অথচ এমন উন্নাসিক উক্তির সময় আমাদের একবারও মনে হয় না যে, যারপরনাই অনেক দিন ধরে শব্দ, ধ্বনি, ব্যাকরণের চর্চা ও কঠোর পরিশ্রম ব্যতীত কথিত বা পঠিত ভাষাও আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। এমন কি বিনা পরিশ্রমে আয়ত্ত করা সম্ভব নয় মাতৃভাষাও। বরেণ্য এমন অনেক চিত্রশিল্পী আছেন যাঁরা সকলেই কবিতা, গদ্য, উপন্যাস ও দর্শনের একাগ্র পাঠক। অথচ খুব কম উপন্যাসিক, কবি, লেখক আছেন যাঁরা এতকুটু কষ্ট করে প্রাচীন বা আধুনিক চিত্রকলার ভাষায় শিক্ষা নিয়েছেন বা শ্রদ্ধা ভরে শিল্পটির চর্চা করেছেন। সৃষ্টিশীল লেখকদের শিক্ষায় তাই বড় রকমের এই ফাঁক থেকেই যায়। আর এই মূল জায়গায় ঘাটতির কারণে তাই চিত্রকলার সঠিক চর্চায়ও উপর্যুপরি ব্যাঘাত ঘটে এবং তার আধুনিক অভিযানও ক্ষুণ্ণ হয় প্রকটভাবে।
ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে উনিশ শতকের শেষ চতুর্থাংশে সাহিত্যের কলমের অগ্ন্যুৎপাত ঝড়ের মতো উথলে উঠলেও চিত্রকলার উত্থান তার থেকে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বাদ পড়ে যায়। তবে শেষের দিকে যখন ইংরেজ শাসক সমাজ তাঁকে এক বিঘ্নতার পথে পরিচালিত করবার চেষ্টা করে তখন চিত্রকলা হঠাৎ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠে এবং সোৎসাহে ধারাবাহিক গতিতে মিলবার চেষ্টা করতে থাকে।
রবীন্দ্রনাথ তখন নিজ প্রতিভায় অনেক দূর এগিয়ে। ভারত বর্ষের বহুল প্রতিভাধরদের ছাপিয়ে সাহিত্য জগতের সিংহাসনে তিনি অধিষ্ঠিত। এবং ভারতীয়দের শিক্ষাদীক্ষায় চিত্রকলা শিক্ষার অভাবের বিষয়ে তিনি তখন দারুণ ভাবে মনঃক্ষুণœ। তিনিই প্রথম তীব্রভাবে চিত্রশিল্পের সামগ্রিক স্বল্পতায় আক্ষেপ প্রকাশ করতে শুরু করেন। কেননা চিত্রশিল্পের অভাবে অপূর্ণতা থেকে যায় সামগ্রিক সাহিত্য।
১৮৭৭-৭৮ সালে রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন মাত্র সতেরো বছর। তখনই তিনি তাঁর পত্রে লিখেছিলেন যে, তিনি কিভাবে ইউরোপীয় চিত্র ঐতিহ্যের অমূল্য সম্পদের রসাচ্ছাদন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
১৮৯০ সালে লুভরে গিয়ে তিনি কত চমৎকার ছবি দেখেছেন সে বিষয়ে তিনি প্যারিস থেকে মৃণালিনী দেবীকে পত্রে লিখেন। নগ্ন নারীর চিত্রও যে কতটা আশ্চর্য সৌন্দর্য ও আনন্দের উদ্রেক করে সে সব অনুভ‚তিও তিনি অকপটে প্রকাশ করেছেন। তার স্ত্রী ও কন্যা বেলার সঙ্গেও সেসব দেখতে তার বিন্দু মাত্র সংকোচ হবে না। অর্থাৎ নগ্ন নারী দেহের সার্থক চিত্র যে নৈসর্গিক আনন্দ সৃষ্টি করে, তার সঙ্গে জাগতিক জৈবিক কামনার কোনও সম্পর্ক নেই। চিত্রশিল্পের মহিমায় তিনি এতটাই শুদ্ধ এবং ঋদ্ধ হয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথই হয়তো একমাত্র আধুনিক শিল্পী যিনি গতানুগতিক ধারার বাইরে অবস্থান করছিলেন। যিনি প্রাচ্যের প্রবাহমান ঐতিহ্য থেকে সরে গিয়ে ক্রমশ ইউরোপীয় ঐতিহ্যের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। আর ইউরোপীয় চিত্রকলার ধারা সে সময় আপন ঐতিহ্যের অবগাহন ডিঙিয়ে নিজস্ব চিত্রকলাকে সম্প্রসারণের প্রচেষ্টায় প্রাচ্য ও আফ্রিকান ঐতিহ্যের পথে আকুল ভাবে অগ্রসরমান। চিত্রকলায় রবীন্দ্রনাথের এই অবস্থানগত পরিবর্তনের ধারা তাঁর সাহিত্যের ক্ষেত্রেও প্রবলভাবে অব্যাহত ছিলো।
ছবি আঁকায় তাঁর নিতান্তই ধৈর্য ছিলো না এমনটাই মনে হয়। এমনকি শুকোতে দেরি হয় বলে, তেল রং তিনি হয়তো কদাচিত ব্যবহার করেছেন।
তিনি শিল্পীর প্যালেট ব্যবহার করেননি। ছবিই ছিলো তাঁর প্যালেট। যেখানে হাইলাইট করা দরকার সেখানে তিনি খানিকটা অস্বচ্ছ রং ব্যবহার করতেন, যা আলো বিকিরণ করে। রঙে এক দুর্লভ দ–্যতি ও ভাস্বরতা তাঁর সবচেয়ে সার্থক কীর্তি। তাঁর আঁকায় কখনও কখনও ঝিনুকের গায়ের এনামেলের মতো ইমপ্যাস্টোর ঝলমলে ভাব আসতো। আর তিনি সেটা করতেন বার্নিশ লাগিয়ে। রঙকে খেলা করতে দিতেন ইচ্ছে মতো।
ভারতের চিত্রকলায় তাঁর রেখা ও রঙের এই অদ্ভুত সমন্বয় এক নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করে। তাঁর প্রতিটি পূর্ণাঙ্গ ছবি যেন প্রাণবন্ত ডাইনামিক পয়েন্ট। সেই সঙ্গে রঙেও এলো এক চমকপ্রদ ছন্দ। যা তাঁর সমস্ত কীর্তিকে একান্তে এক সূত্রে গেঁথে ফেলে। যা চমৎকার রূপে সময়োচিত, আধুনিক এবং একই সংগে দৃঢ় প্রাচ্য। এবং বিষয় নির্ভর বা কাব্যের ভাবের নির্ভরতা ছাড়িয়ে একান্তই নিজস্বতার মহিমায় তিনিই তখন প্রথম শুদ্ধ মহৎ চিত্রের জনক হয়ে উঠলেন। জীবন এবং সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ একান্তভাবেই ছিলেন বিশ শতকের পরিপূর্ণ সঞ্চালক। তাঁর যেকোনো কাজে সেসবের প্রমাণ আমরা পেয়ে যাই। সাহিত্যে তিনি কখনও অস্বীকার করেননি আধুনিকতার বিড়ম্বিত বিবেককে, মুখ ফেরাননি সময়ের ঘাত-- প্রতিঘাত থেকে, উপেক্ষা করেননি সাংস্কৃতিক সংকটকে। ঠিক তেমনি চিত্র জগতেও সরাসরি নিয়ে এলেন জীবনের দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, সংশয় এবং মুক্তির বাণী।
ভারতীয় উপমহাদেশে তাঁর কীর্তি সব কিছু ছাপিয়ে তাই যোগ্য স্থান করে নিয়েছে। এবং অবচেতনভাবেই সময়ের সার্থক চিত্র শিল্পীদের মনের গভীরে অনন্ত অবগাহন করে যাচ্ছেন অদ্যাবধি, আলোড়িত করবেন আরও অনেক আগামী দিন। সকল জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে তাই চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ।
(তথ্য ঋণ ---‘বিংশ শতকের ভারতীয় চিত্রকলা ও রবীন্দ্রনাথ’ --অশোক মিত্র)
লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট