চশমা || লতিফ জোয়ার্দার


- ২৬ ডিসেম্বর ২০২০, ১৬:১৮
চশমাটার একটা ঠ্যাং ভেঙে যাওয়ার পর! দীর্ঘ ছয় মাসে আর একটা নতুন চশমার ব্যবস্থা হলো না মহসিনের। অথচ সেই কবে চশমা পরা শুরু করেছিল! এখন আর ঠিক মনে পড়ে না। একজন চোখের চিকিৎসকও দোরগোড়ায় নেই তাদের। চোখ দেখাতে হলে নিদেন পক্ষে বার কিলো পথ পারি দিতে হয়। রিকশা, অটো অথবা ইচ্ছে হলে পায়ে হেঁটেও যাওয়া যেতে পারে ঈশ্বরদী শহরে।
ঈশ্বরদী উপজেলা শহর হলেও অনেক অনেক জেলা শহরের চেয়ে উন্নত এখন। অত্যাধুনিক মার্কেট। রেল জংশন, বিমানবন্দর, ইপিজেট, আর রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের জন্য। রাতদিন অসংখ্য মানুষের কোলাহল। দেশি মানুষের মতো রুশ, চীনাসহ অনেক দেশের মানুষ হরহামেশায় ঘুরে বেড়ায় এই শহরে। তবে মহসিন এসব কোলাহলে নেই। মহসিন কোনো ভিড়ে নেই।
তবে হাটের দিন হলে, সন্ধ্যাবেলা বাজার করতে যায় একটু কম দামের আশায়। ডিসেম্বর মাস শীতের নতুন সবজিতে বাজার সয়লাব। অল্প টাকায় ব্যাগ বোঝাই করে বাজার করতে পারে সবাই। মহসিনের বউ ইলা। ইলোরা থেকে কবে কীভাবে ইলা হলো, এ হিসেব আর এখন কেউ জানে না। বিয়ের বয়স সতেরো বছর। ওদের নিজেদের মধ্যে বেশ মানিয়ে নিতে না পারার ব্যর্থতা আছে। আছে নিজেদের মধ্যে দিন রাতের ব্যবধান। দিনের শুরুতে যে দূরত্ব অঙ্কন করতে করতে একে অপরকে আড়াল করে। রাতের অন্ধকারে সেই আড়াল নিমিষেই হারিয়ে ওরা আবার জৈবিক বন্ধনে মেতে, দিনের দূরত্ব হারায়।
ইলার চোখের অসুখ আজ প্রায় দুই বছর। এক সময় রাতদিন কাঁথা সেলাই করত। বাড়িতে সিঙ্গার সেলাই মেশিনে দর্জির কাজ করত। করতে বললে ভুল বলা হয়। এখনো করে, তবে এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারে না। রাতের বেলায় তো ওমুখি কখনো হয় না আর। এখন মাঝে মধ্যে অবশ্য এক চোখ লাল হয় ইলার। মহসিন এসব দেখেও দ্যাখে না। ব্লাডপেসার বৃদ্ধি পেলে নাকি কখনো কখনো এমন হয়।
বাজারের গ্রাম্য ডাক্তার শফিক মাসে দু’-একবার এসে ব্লাডপেসার মেপে দিয়ে যায়। মহসিনের মতোই এলোমেলো ইলার ব্লাডপেসার। কখনো কমে আবার কখনো আবার বাড়ে। বাইজোরান-২০ নিয়মিত খেতে হয় এজন্য। কিন্তু সবকিছু ঠিকমতো চললেও একমাত্র চোখের ব্যাপারে অবহেলা মহসিনের। আজ কাল পরশু করে মহসিন বারবার এড়িয়ে যায়। আর এভাবেই নানা সমস্যার ডালপালা গজায় ওদের সংসারে।
নানা অজুহাতে ভুলে যায় চোখের চিকিত্সক, চোখের জন্য চশমা এ জাতীয় শব্দগুলো। এ নিয়ে ইলার যত না দুঃখবোধ। তারচেয়ে বেশি মহসিনের। ব্যর্থতার সুনিপুণ কারুকার্যে দিনে দিনে ওরা ভুলে যায়, একটা চশমার প্রয়োজনীতা। ইলার সেলাই মেশিনের সুঁচে সুতো না পরাতে পারার ব্যর্থতা। আর মহসিনের কম্পোজ, বই পড়তে না পারার দুঃখ যখন প্রবল সে াতে প্রবাহমান যখন। তখন ওরা নিজেদের ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের দিকে হাত বাড়ায়।
দিনক্ষণ সব ঠিক করার পরও ঈশ্বরদীতে আর যাওয়া হয় না। মহসিনের বাড়ির সামনে পাকা রাস্তায় দিয়ে এখন অসংখ্য মানুষ চলাচল করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কিছু সময় পর পর মাইকিং এর শব্দ শোনা যায়। ইদানীং ভাংড়িওলা থেকে শুরু করে আচারওলা। কাপড় জুতা সেন্ডেল থেকে শুরু করে জিরা মসলা চাউল পর্যন্ত মাইকিং করে বিক্রি হয়। আর বুধবার বিকেল বেলায় তো মহিষের মাংসের বিজ্ঞাপনে এমনভাবে বলে যে, মাংসের স্বাদ এসে মুখে উঁকি মারে। আগামীকাল বৃহস্পতিবারে হাটে একটি সুস্থ সবল, সুন্দর, বিশাল আকৃতির মহিষ জবাই হবে।
আপনারা যারা মহিষের মাংস পছন্দ করেন। তারা আগামীকাল রাজাপুরহাটে মাংস হাটায় চলে আসুন। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন নিয়ে তো আরিফিন রাজ উপস্থিত হয় প্রায় দিনই। শুনতে শুনতে ইলা আর এসব কানে তোলে না। আর তুলেই বা কী হবে! যার স্বামীর কোনো মুরোদ নেই। সতের বছরে এক ঈদে মনে হয় একটা শাড়ি উপহার দিয়েছিল মহসিন।
ঈদ এলেই যেন তার হাতশূন্য হয়। কামকাজ বন্ধ হয়। অনেক সময় সেমাই চিনি কেনার পয়সা থাকে না। তাই তাদের মতো মানুষের শুধু শুধু আশা করতে নেই। আর এখন আর তেমন কোনো আশা করেও না ইলা। আর করেই কী লাভ। হয়ত মহসিন বলবে,—দ্যাখো ইলা, আমাদের দিন তো শেষ হয়ে এলো। সংসারে কত খরচ। ছেলে-মেয়ে দুটির লেখাপড়া। শুনো, আমার সামনে এসব গীত গাইয়ো না। আমি তোমার খ্যামতা, তোমার মুরোদ এই সতের বছরে সব জানি। এসব কথায় ইলার সামনে থেকে উঠে যায় মহসিন। নিজের কোনো ব্যর্থতা মুক্তির থেকে উপায় খুঁজে পায় না।
আশপাশের মানুষগুলো ইদানীং সবাই কর্মমুখী হয়ে পড়েছে। ছেলে নেই মেয়ে নেই, সবাই এখন পারমাণবিকে নয়তো ইপিজেটে চাকরি করে। সকালবেলায় একটার পর একটা বাস এসে মেয়েদের ইপিজেটে আর ছেলেদের পারমাণবিকে নিয়ে যায়। ইলা ঘর থেকে বের হয়ে তাকিয়ে দ্যাখে। সেও তো ইচ্ছে করলে ইপিজেটে কাজ করতে পারে। কিন্তু এই মরার সংসারের জন্য কোথাও যেতে পারে না।
কী যে ভুল করে ছিল জীবনে! এই অকর্মণ্য মানুষটাকে বিয়ে করে। অথচ কত বড় বাড়ির থেকে বিয়ের সম্পর্ক আসতো ইলার জন্য। আর আসবেই না বা কেন! দেখতে তো কম সুন্দর নয় ইলা। পাড়ার ছেলেরা তো জ্বালিয়ে মারতো। কেউ কেউ হাতের মধ্যে চিঠি ধরিয়ে দিত। কেউ আবার বান্ধবীর মাধমে প্রেমের প্রস্তাব পাঠাতো। কিন্তু কাউকেই পাত্তা না দিয়ে মহসিনের প্রেমে পড়াই ছিল তার জীবনের বড় ভুল।
যেজন্য আজও বাবা-মা পর হয়ে আছে। গেলে ঠিকমতো কথা বলে না। কখনো কোনোদিন থাকতে বলে না। আর মহসিন তো ও বাড়ি যেতেই চায় না। জামাই হয়েছে বলে কী তার আত্মমর্যাদা বলে কিছু নেই। আর ইলাও যেতে দিতে চায় না কখনো। আর দেবেই বা কেন! যেখানে তার কোনো মূল্যায়ন নেই আজও।
দুপুরবেলায় মহসিনের জন্য ভাত বেড়ে বসে আছে ইলা। মানুষটা যতই অকর্মণ্য হোক। যতই রাগ হোক তার উপর। এখনো তো ইলা তাকে ভালোবাসে। আর তার জন্য অপেক্ষা করবে না তো কার জন্য অপেক্ষা করবে। বারান্দায় পাটি পেতে খাবার সাজিয়ে এভাবে ইলা কতদিন বসে থাকে। কোনো কোনো দিন মহসিন ঘরে ফিরে না। কাজে আটকা পরে। তার পরও ইলা অপেক্ষা করে। নিজে ভাত না খেয়ে বসে থাকে। আজ নিজে মাঠে গিয়ে বইতির শাক তুলে এনেছে। এই শাক আবার মহসিনের বড় প্রিয়।
শুকনো মরিচ ভেজে রেখেছে মহসিনের জন্য। সাথে নতুন আলু ভর্তা আর মসুরের ডাল রান্না। ইলার তো মসুরের ডাল আর আলু ভর্তা হলে আর কিছু লাগে না। ছেলে-মেয়ে দুটি অবশ্য মাছ ভাত ছাড়া খেতে চায় না। সেজন্য বড়শি দিয়ে নিজেদের পুকুর থেকে মাঝে মধ্যে মাছ ধরে ইলা। দু টুকরো মাছ ভেজে দিলে ছেলে-মেয়ে দুটি পেট ভরে ভাত খেয়ে ওঠে। ইলার কাছে এদৃশ্য জগতের সবচেয়ে বড় শান্তির বিষয়। তখন প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে পারে ইলা। মহসিনের এসবে কিছু আশে যায় না। পুরুষ মানুষ কী এমনি হয়। একটা পাষণ্ড! একটা অদ্ভুত জীব-জানোয়ারের মতো।
সাড়ে তিনটার দিকে ঘরে ফিরে মহসিন। মানুষটাকে দেখে আজ খুব হাসি-খুশি মনে হয়। কিন্তু ইলার গম্ভীরতার কাছে সেই হাসি এক সময় ম্লান হয়ে যায়। চেতে উঠে ইলা, তুমি মানুষ না অন্য কিছু। জানোই তো তোমাকে রেখে আমি ভাত খেতে বসি না। আর তুমি? ইলা রেগে গেলে মহসিন কিছু সময় চুপ থাকে। ইলাকে খুব বেশি রাগাতে পারে না। আর পারবেইবা কী করে! মানুষটা সবার কাছে সারাজীবন অবহেলা পেয়ে এসেছে। বাবা-মা থেকেও যেন নেই। এক সময় ইলা মহসিনের দিকে তেড়ে যায়।
অনেকটা মারমুখী হয়! কী ব্যাপার তুমি আমাকে মানুষ মনে কর না। নির্লজ্জের মতো ফিক ফিক করে হাসছে যে? না আজ আমার জন্য দামি কোনো উপহার নিয়ে এসেছো তুমি? এই এক কথা তুমি সারাজীবন বলে গেলে আমায়। জানো তো সবই! আমার ব্যর্থতাগুলো কী এভাবেই না বললেই নয়। কিছু দিতে পারিনি! সেতো তুমি আমি ভালোই জানি। জানি, শুধু ভালোবাসা দিয়ে পেট ভরে না। সামান্য একজন চোখের ডাক্তারের কাছেও তোমাকে নিয়ে যেতে পারি না। খোটা তো তুমি আমাকে দিবেই, দাও। এবার ইলার মন খারাপ হয়। মনে হয় এই মানুষটাকে এভাবে বলা তার উচিত হয়নি আজ।
সাড়ে চারটার দিকে ইলা আর মহসিন দুপুরের খাবার নিয়ে বসে। খেতে খেতে আরো একবার উঠে দাঁড়ায় মহসিন। কথা না বলে যেন থাকতে পারছিল না। এত বড় একটা সুখবর কোনোভাবেই চাপা রাখতে পারে না। পকেট থেকে একটা লিফলেট বের করে ইলার দিকে এগিয়ে ধরে। ওটা আবার কি? আর খেতে খেতে আমি ওসব কিছু দেখতে পারব না। তুমি না হয় তোমার সুখবর মুখেই বল? জানো ইলা, আজ আমাদের চোখের ডাক্তার আর চশমার সমাধান হয়েছে। বুঝেছি আবার কার ধাপ্পায় পড়েছো তুমি।
সত্যি বলছি, কোনো ধাপ্পা নয়। আগামীকাল দাশুড়িয়া চক্ষু হাসপাতালে সিরাজগঞ্জ থেকে চুক্ষ ডাক্তার আসবে? সে তো প্রতি সপ্তাহতেই আসে। তাতে করে কী! আমাদের চোখের অসুখ ভালো হয়ে যাবে। — তা বলছি না। এই দ্যাখো দশ টাকার দুটো টিকিট কেটে এনেছি আজ। এই টাকায় চোখ দেখবে ডাক্তার। আর বিদেশি এক এনজিও বিনা পয়সায় সবাইকে চশমা দেবে। মহসিনের এ সংবাদে অবাক হয় ইলা। কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হয় তার।

