Image description

বিদ্যুৎ সংকট, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, ডলার বাজারের অস্থিরতাসহ নানা বিষয় নিয়ে এমনিতেই সরকার চাপের মধ্যে রয়েছে। এরমধ্যে নির্বাচন ও নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিদেশিদের নানামুখী তৎপরতায় মাথা বিগড়ে যাওয়ার জোগার। সেই সঙ্গে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর মাঠ গরমের রাজনীতি তো রয়েছেই। এমন ঘোলাটে পরিস্থিতিতে সরকারের মন্ত্রীরা যেন কথার খৈ ফুটাচ্ছেন। যে যেভাবে পারছেন কথা বলছেন। এই কথাগুলো অনেক ক্ষেত্রে সমন্বয়হীন এবং অনেক ক্ষেত্রে স্ববিরোধীও হয়ে উঠছে। এমনকি সরকারপ্রধানের নেয়া অবস্থানকেও করছে প্রশ্নবিদ্ধ। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের নেতাকর্মীরা তো বটেই সাধারণ জনগণও সংক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন। তারা বলছেন, বাছ-বিচার ছাড়াই মন্ত্রীদের দেয়া স্ববিরোধী বক্তব্য নির্বাচনের আগে সরকার ও সরকার প্রধানকে বেকায়দায় ফেলবে। বিরোধী শক্তিগুলো এই সুযোগ নিয়ে সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে, যা আওয়ামী লীগ কিংবা ১৪ দলের জন্য সুখকর হবে না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের মধ্যে এই সমন্বয়হীনতা নতুন নয়। টানা তিন মেয়াদে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পরই মন্ত্রীদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। এনিয়ে ১৪ দল এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীকেও অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। সে সময় মন্ত্রীদের কাউকে কাউকে ডেকে নিয়ে সতর্কও করেছেন সরকারপ্রধান। তারপরও মন্ত্রীদের কেউ কেউ স্ববিরোধী বক্তব্য দেয়া থামাননি। অবশ্য এতোদিন বিষয়টি নিয়ে কারও মাথাব্যথাও তেমন ছিল না। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন ও নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সরকারপ্রধানের বক্তব্য আসার পর মন্ত্রীরাও সরব হয়ে উঠেন। বিরোধী দলের নানা সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে তারা একেক জন একেক ধরনের কথা বলছেন যা সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে।

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি করে আসা বিএনপি ও তাদের সতির্থদের চলমান আন্দোলনের মধ্যেই গত ১৫ মে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নির্বাচনকালীন সরকারে সংসদে থাকা দলগুলো চাইলে তাদের কাউকে কাউকে মন্ত্রিত্ব দেয়ার ইঙ্গিত দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে বিএনপির মতো সংসদে যারা নেই, তাদের বিষয়টি চিন্তায় নেই বলে তিনি জানান। গণভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নির্বাচনকালীন সরকারে বিরোধীদের রাখার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এটুকু উদারতা দেখাতে পারি। পার্লামেন্টে যারা আছে, তাদের মধ্যে কেউ যদি ইচ্ছা প্রকাশ করে যে নির্বাচনকালীন সরকারে তারা আসতে চায়, আমরা নিতে রাজি আছি। এই উদারতা আগে আমরা দেখিয়েছি। এমনকি ২০১৪ সালে আমি খালেদা জিয়াকেও আহŸান করেছিলাম। তারা তো আসেনি। এখন তো তারা নাইও পার্লামেন্টে। কাজেই ওদের নিয়ে চিন্তারও কিছু নাই।’

প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর বিএনপি তাদের প্রতিক্রিয়ায় জানায়, এসব নিয়ে বিএনপি ভাবছে না। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনই তাদের একমাত্র চাওয়া। এরপর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিএনপি যদি নির্বাচনে আসার গ্যারান্টি দেয় তাহলে তাদের নির্বাচনকালীন সরকারে স্থান দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হতে পারে।’ দলের সাধারণ সম্পাদকের এই বক্তব্য শুনে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই। যেখানে প্রধানমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন সংসদে প্রতিনিধিত্ব না করায় বিএনপিকে নির্বাচনকালীন সরকারে রাখা যাবে না সেখানে ওবায়দুল কাদের কোন ভিত্তিতে এমনটি বলেছেন তা কারো বোধগম্য হয়নি।

তবে সব ছাপিয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুর দেয়া বক্তব্যে নতুন করে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। গত মঙ্গলবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ১৪ দলের সমাবেশে তিনি গণতন্ত্রের স্বার্থে প্রয়োজনে জাতিসংঘের প্রতিনিধির মধ্যস্থতায় বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হতে পারে বলে জানান। আমির হোসেন আমু বলেন, দেশে গণতন্ত্রের স্বার্থে নির্বাচনী সমস্যা সমাধানে আলোচনা হতে পারে। প্রয়োজনে জাতিসংঘের প্রতিনিধি আসুক। আমরা বিএনপির সঙ্গে মুখোমুখি বসে আলোচনা করতে চাই। আলোচনায় সমাধান হবে, অন্য কোনো পথে নয়। বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করে লাভ নেই। এর একদিন পর আমির হোসেন আমু বলেছেন, নির্বাচনকে নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। আলোচনার জন্য কাউকে বলা হয়নি, কাউকে দাওয়াত দেয়া হয়নি। কাউকে আহ্বান করা হয়নি এবং এর সুযোগও নেই। এটা আওয়ামী লীগের বাড়ির দাওয়াত নয় যে দাওয়াত করে এনে খাওয়াব। গতকাল ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

এদিকে আমুর মঙ্গলরের বক্তব্যের পর গতকাল বুধবার সংলাপের বিকল্প নেই বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন তথা গণতন্ত্রের স্বার্থে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেন, সংলাপ চলমান থাকবে। সংলাপের বিকল্প নেই। আমরা মনে করি, সবকিছুই সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সদরদপ্তরে স্বাধীনতা পুরস্কার-২০২৩ উদযাপন অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ একটি পপুলার পার্টি। আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায়। আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে জনগণের ক্ষমতায় চলতে হবে। জনগণের ক্ষমতা অব্যাহত রাখতে হলে সবার সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। তাই সংলাপ বা আলোচনার বিকল্প কিছু নেই।

এরপরই বিষয়টি নিয়ে বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। গতকাল বুধবার সকালে ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবসের আলোচনায় তিনি বলেন, বিএনপির সঙ্গে সংলাপ বা আলোচনার ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। দেশে এমন কোনো রাজনৈতিক সংকট হয়নি যে জাতিসংঘের এখানে ইন্টারফেয়ার করতে হবে। জাতিসংঘ মধ্যস্থতা করবে এমন কোনো সংকট স্বাধীন বাংলাদেশে হয়নি। একই কথা বলেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদও। আমির হোসেন আমুর বক্তব্যটি তার ব্যক্তিগত বলে মন্তব্য করে এই মন্ত্রী বলেন, সংলাপ নিয়ে বক্তব্যটি তার ব্যক্তিগত। এ বক্তব্য নিয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় ফোরামে কোনো আলোচনা হয়নি, এমনকি ১৪ দলেও আলোচনা হয়নি। ড. হাছান বলেন, নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন। তারা নির্বাচনের রেফারি। তারা যদি সংলাপে ডাকে আমরা যাব। মন্ত্রী বলেন, তার সঙ্গে (আমু) যোগাযোগ করা হয়েছে। তিনি বলেছেন গণমাধ্যমে যেভাবে এসেছে তিনি ঠিক সেভাবে বলেননি। যেভাবেই আসুক এটি তার ব্যক্তিগত অভিমত। এটি দল, সরকার এমনকি ১৪ দল কোথাও এ নিয়ে আলোচনা হয়নি। তাহলে কি আলোচনার সুযোগ নেই? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপির যদি নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রসঙ্গ থাকে সেটি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে। নির্বাচন আয়োজক প্রতিষ্ঠান হচ্ছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন যদি আমাদের ডাকে আমরা নির্বাচন কমিশনে যাব।

মন্ত্রীদের সমন্বয়হীনতার বিষয়টি নিয়ে এর আগেও সমালোচনা হয়েছে ব্যাপকভাবে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি নিয়ে মন্ত্রিরা একেক জনের একেক বক্তব্য সরকারকে বিব্রত করেছে। ওই সময় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে শেখ হাসিনা সরকার নিরুপায় হয়ে দাম বাড়িয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খাতে প্রভাব পড়বে এটাই স্বাভাবিক।’ একই বিষয় নিয়ে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘মূল্যবৃদ্ধির পরও দেশে জ্বালানি তেলের দাম ভারতের সমান ও আশপাশের অনেক দেশের তুলনায় কম।’ বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদি ভালোর জন্য মাঝে মাঝে কষ্ট করতে হয়।’ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘যুক্তি ছাড়া তেলের দাম বাড়ানো হয়নি।’ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘নিরুপায় হয়েই জ্বালানির দাম সমন্বয় করেছে সরকার।’ পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘আমরা যে জায়গায় চিন্তা করছি; এটাই শেষ নয়, খাদ আরও গভীর। আমরা পেট্রল, ডিজেল তৈরি করি না। যারা মূল মহাজন, তারা যখন দাম বাড়ায়, তখন আমাদের কিছু করার থাকে না।’ আর তথ্য সচিব বলেন, এটা হচ্ছে আমাদের পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের লোকসান বাঁচানোর জন্য।’

পরবর্তীতে পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের দুই রকম বক্তব্য নিয়ে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। সে সময় মন্ত্রীদের মধ্যে সমন্বয়হীনতায় ক্ষোভ প্রকাশ করে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মরহুম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, মন্ত্রীদের সমন্বয়হীনতা অন্যদের কথা বলার সুযোগ করে দিচ্ছে। এতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। আপনারা একমত হয়ে কথা বলুন, নইলে কথা বলবেন না। বিব্রত করবেন না আমাদের। এভাবে কথা বললে প্রধানমন্ত্রীর অনেক সাফল্য ম্লান হয়ে যায়।

অবশ্য সেসময় বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম জানিয়েছিলেন, বড় মন্ত্রিপরিষদের কারণে এক ধরনের সমন্বয়হীনতা দেখা যায়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো এত বেশি মন্ত্রী কোনো দেশে দেখা যায় না। যুক্তরাজ্যে সাতজন মন্ত্রী, যুক্তরাষ্ট্রে ১৩ জন। স্বাভাবিকভাবেই একটি দেশে এত বড় সরকার হলে সেখানে কিছু সমন্বয়হীনতা থাকবে।

মানবকণ্ঠ/এআই